ললাটের লিখন
অনেক সময় অসম্ভব, বিশেষত যখন সেই মুখে কোনো আবেগের তরঙ্গ খেলে, হয় দুর্নিবার হাসি পায়, নয় ওকে পীড়িত করে।

পৃথ্বীশের ভাবোচ্ছাস থামিয়ে দিয়ে বাঁশরি বললে, “ কাজের কথার জন্যে ডেকেছি, অন্য অবান্তর কথার প্রবেশ স্ট্রিক্টলি প্রোহিবিটেড। ”

পৃথ্বীশ ক্ষুণ্ন হয়ে বললে, “ জরুরি কথা এত কী আছে। ”

“ জরুরি নয়! এই বুঝি তুমি আর্টিস্ট। নিজের চক্ষে দেখলে আসন্ন ট্র্যাজেডির প্রলয় সংকেত। এখনো রঙের তুলি বাগিয়ে ধরতে মন ছট্‌ফট্‌ করছে না? আমার তো কাল সারারাত ঘুম হল না। কী বলব, বিধাতা শক্তি দেন নি নইলে এমন কিছু বলতুম যার অক্ষরে অক্ষরে উঠত আগুনের ফোয়ারা। আর্টিস্টের মতো দেখতে পাচ্ছি সমস্তটাই স্পষ্ট, অথচ আর্টিস্টের মতো বলতে পারছি না স্পষ্ট করে। চতুর্মুখ যদি বোবা হতেন তা হলে অসৃষ্ট বিশ্বের ব্যাথায় মহাকাশের বুক যেত ফেটে। ”

“ বাঁশি, কে বলে তুমি প্রকাশ করতে পার না? কে বলে তুমি নও পুরো আর্টিস্ট? তোমার শক্তির যে-সব প্রমাণ মুখে-মুখে যেখানে-সেখানে হরির লুটের মতো ছড়িয়ে ফেলো দেখে আমার ঈর্ষা হয়। ”

“ আমি যে মেয়ে, আমার প্রকাশ ব্যক্তিগত। বলবার লোক স্পষ্ট সামনে পেলে তবেই বলতে পারি। কেউ নেই অথচ বলা আছে এইটে পুরুষ আর্টিস্টের। সেই বলা চিরকালের — আমাদের বলা যত হোক সে কেবল নগদ বিদায় দিনেদিনের। ঘরে ঘরে মুহূর্তে মুহূর্তে সে বুদ্‌বুদের মতো উঠছে আর মেলাচ্ছে। ”

পুরুষ আর্টিস্টের অহংকার ঘনিয়ে উঠল, সে বললে, “ আচ্ছা বেশ, কাজ শুরু হোক। কাল বলেছিলে একটা চিঠির কথা। ”

“ এই নাও”, ব'লে একটা চিঠির কপি করা এক অংশ ওকে পড়তে দিলে। তাতে আছে — “ প্রেমে মানুষের মুক্তি। কবিরা যাকে ভালোবাসা বলে সেটা বন্ধন। তাতে একজন মানুষকে আসক্তির দ্বারা বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে তাকেই তীব্র স্বাতন্ত্র্যে অতিকৃত করে তোলে। যত তার দাম প্রকৃতিজুয়ারি তার চেয়ে অনেক বেশি ঠকিয়ে আদায় করে। এই তো প্রকৃতির চাতুরি, নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে। মোহের জাদু লাগিয়ে এই মরীচিকার সৃষ্টি। এই কথাটাকেই শেক্সপিয়ার কৌতুকচ্ছলে দেখিয়েছেন তাঁর ভরাবসন্তের স্বপ্নে। প্রেম জাগ্রত দৃষ্টি, নরনারীর ভালোবাসা স্বপ্নদৃষ্টি নেশার ঘোরে। প্রকৃতি মদ ঢেলে দেয় দেহের পাত্রে, তাতে যে অনুভূতিকে তীব্র করে, তাকে সহজ সত্যবোধের চেয়ে বেশি সত্য বলে ভুল হয়। এই ভোলানোটা প্রকৃতির স্বরচিত। খাঁচাকেও পাখি ভালোবাসে যদি তাকে আফিমের নেশায় বশ করা যায়। বন্ধনের প্রতি আসক্তিকে সর্বান্তঃকরণে ভয় করো, জেনো ওটা সত্য নয়। সংসারে যত দুঃখ, যত বিরোধ সকলের মূল এই ভ্রান্তি নিয়ে, যে ভ্রান্তি শিকলকে মূল্যবান করে দেখায়। কোন্‌টা সত্য কোন্‌টা মিথ্যে যদি চিনতে চাও, তবে বিচার করলেই বুঝতে পারবে কোন্‌টাতে মুক্তি দেয়, কোন্‌টাতে দেয় না। প্রেমে মুক্তি, আসক্তিতে বন্ধন। ”

“ চিঠি পড়লুম। তার পরে?” “ তারপরে তোমার মাথা, অর্থাৎ কল্পনা। মনে মনে শুনতে পাচ্ছ না, শিষ্যকে বলছেন সন্ন্যাসী — ভালোবাসা আমাকেও না, ভালোবাসা আর কাউকেও না। নির্বিশেষ প্রেম, নির্বিকার আনন্দ, নিরাপদ আত্মনিবেদন, এই হল দীক্ষামন্ত্র। ”

“ তা হলে এর মধ্যে সোমশংকর আসে কোথা থেকে?”

সেই রাস্তাই তো তৈরি হল প্রেমে। সন্ন্যাসী বলেছেন প্রেমে সকলেরই অধিকার। সোমশংকরের তাতে পেট ভরবে না, সে চেয়েছিল বিশেষ প্রেম, মীনলাঞ্ছনের মার্কা মারা। কিন্তু সর্বনাশে সমুৎপন্নে যথালাভ, অর্ধেকের চেয়ে কম হলেও চলে। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, সুষমা ওকে খুব গম্ভীর সুরে বলেছিল, যে-প্রেম বিশ্বের সকলের জন্যে আমাদের দুজনের মিলন সেই প্রেমের