পরিশিষ্ট
অনাবশ্যকবোধে পুত্রশোকের প্রতি কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করে নাই।

সম্প্রতি এই গার্হস্থ্যপ্রধান সমাজের কিছু রূপান্তর ঘটিয়াছে। ইহার মধ্যে একটা নূতন বন্যার জল প্রবেশ করিয়াছে। তাহার নাম পাব্লিক।

পদার্থটিও নূতন, তাহার নামও নূতন। বাংলা ভাষায় উহার অনুবাদ অসম্ভব। সুতরাং পাব্লিক শব্দ এবং তাহার বিপরীতার্থক প্রাইভেট শব্দ বাংলায় প্রচলিত হইয়াছে, কেবল এখনো জাতে উঠিয়া সাহিত্য-সভায় স্থান পায় নাই; তাহাতে তাহাদের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই, সাহিত্যেরই সমূহ অসুবিধা। যখন কথাটা বলিবার দরকার হয় তখন শব্দটা কোনোমতে উচ্চারণ না করিয়া ভাবে ভঙ্গিতে ইশারায় ইঙ্গিতে সাধু সাহিত্যকে বহু কষ্টে কাজ চালাইতে হয়। কিন্তু এই বিদেশী শব্দটা যখন সাধারণের বোধগম্য হইয়াছে তখন আর এ-প্রকার দুরূহ ব্যায়ামের আবশ্যক দেখি না।

এক্ষণে আমাদের সমাজে যখন, কেবল গৃহ নহে, পাব্লিকের অস্তিত্বও ক্রমশ দীপ্যমান হইয়া উঠিয়াছে, তখন এখানে ক্রমে ক্রমে এক-একটি করিয়া পাব্লিক-কর্তব্যের আবির্ভাবও অবশ্যম্ভাবী।

যেমন আমাদের দেশে পিতৃশ্রাদ্ধ প্রকাশ্য সভায় অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে এবং প্রত্যেক পিতৃহীন ব্যক্তির পিতৃশোক ব্যক্ত করা প্রকাশ্য কর্তব্যস্বরূপে গণ্য হয় তেমনি পাব্লিকের হিতৈষী কোনো মহৎ ব্যক্তির মৃত্যুতে প্রকাশ্য সভায় শোকজ্ঞাপন একটা সামাজিক কর্তব্যের মধ্যে গণ্য হওয়া উচিত। গার্হস্থ্যপ্রধান সমাজে প্রায় প্রত্যেক পিতাই বীর। তাঁহাদিগকে বিচিত্র কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে হয় এবং সমস্ত পরিবারের জন্য পদে পদে ত্যাগস্বীকার করিয়া আত্মসুখ বিসর্জনপূর্বক চলিতে হয়। যাহাদের হিতের জন্য তাঁহারা ধৈর্যের সহিত বীর্যসহকারে আমৃত্যুকাল সংসারের কঠিন কর্তব্যসকল সাবধানে পালন করিয়া চলেন তাহারা সর্বসমক্ষে সেই আত্মসুখে উদাসীন হিতব্রত গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি প্রদর্শন করিবে ইহা সমাজের শাসন। তেমনি, যাঁহারা কেবল আপনার ঘরের জন্য নহে, পরন্তু পাব্লিকের হিতের জন্য আপন জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, মৃত্যুর পরে তাঁহাদের প্রতি প্রকাশ্য ভক্তি স্বীকার করা কি পাব্লিকের কর্তব্য নহে? এবং প্রকাশ্যে ভক্তি স্বীকার করিতে গেলেই কি ব্যক্তিগত শোককে সংযমে আনা আবশ্যক হয় না। এবং একজন বিশেষ বন্ধু রুদ্ধদ্বার গৃহের মধ্যে যেরূপ ভাবে শোকোচ্ছ্বাসকে মুক্ত করিয়া থাকেন সাধারণের নিকট কি কখনো সেরূপ শোকপ্রকাশ প্রত্যাশা করা যায়? এবং সাধারণের পক্ষে সেরূপ শোক সম্ভব নহে বলিয়াই কি সাধারণ শোকের কোনো মূল্য নাই এবং তাহা নিন্দনীয়?

এ কথা আমি অস্বীকার করি না যে, আমাদের দেশের পাব্লিক আমাদের দেশীয় মহাত্মা লোকের বিয়োগে যথোচিত শোক অনুভব করে না। আমাদের এই অল্পবয়স্ক পাব্লিক অনেকটা বালক-স্বভাব। সে আপনার হিতৈষীদিগকে ভালো করিয়া চেনে না, যে উপকারগুলি পায় তাহার সম্পূর্ণ মূল্য বুঝে না, বন্ধুদিগকে অতিশীঘ্রই বিস্মৃত হয় এবং মনে করে আমি কেবল গ্রহণ করিব মাত্র কিন্তু তাহার পরিবর্তে আমার কোনো কর্তব্য নাই।

আমি বলি, এইরূপ পাব্লিকেরই শিক্ষা আবশ্যক এবং সভা আহ্বান ও সেই সভায় আলোচনাই শিক্ষার প্রধান উপায়। যাঁহারা চিন্তাশীল সহৃদয় ভাবুক ব্যক্তি তাঁহারা যদি লোকহিতৈষী মহোদয় ব্যক্তিদিগের বিয়োগশোককে নিজের হৃদয়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখিয়া দেন, তাহাকে যদি সাধারণ শোকের উদার বৃহত্ত্ব দান না করেন, তাঁহারা যদি সাধারণকে ক্ষুদ্র ও চপল বলিয়া ঘৃণা করিয়া দেশের বড়ো বড়ো ঘটনার সময় শিক্ষাদানের অবসরকে অবহেলা করেন, এমন-কি, যখন দেশের লোক সুসময়ে দুঃসময়ে তাঁহাদের দ্বারে গিয়া সমাগত হয় তখন বিমুখ হইয়া তাহাদিগকে নিরাশ ও নিরস্ত করিতে চেষ্টা করেন এবং সেই তিরস্কৃত সম্প্রদায় নিজের স্বল্প বুদ্ধি ও সামর্থ্য অনুসারে তাঁহাদের বিনা সাহায্যে যাহা-কিছু করে তাহাকে তুচ্ছ বলিয়া ধিক্‌কার করেন, তবে তাঁহারা আমাদের বর্তমান সমাজকে বর্তমানকালোপযোগী একটি প্রধান শিক্ষা হইতে বঞ্চিত করিয়া থাকেন।

বিশেষত আমাদের দেশে সাহিত্য-সমাজ নাই এবং সমাজের মধ্যে সাহিত্যের চর্চা নাই। য়ুরোপে যেরূপভাবে সামাজিকতার চর্চা