পরিশিষ্ট
হয় তাহাতে যশস্বী লোকেরা নানা উপলক্ষে নানা সভায় উপস্থিত হন। তাঁহারা কেবলমাত্র আপন পরিবার এবং গুটিকতক বন্ধুর নিকটেই প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত নহেন। তাঁহারা নিয়তই সাধারণের সমক্ষে অবস্থিতি করিতেছেন। তাঁহারা স্বদেশীয় নরনারীর নিকটবর্তী, সম্মুখবর্তী, দৃষ্টিগোচর। এইজন্য তাঁহারা যখন লোকান্তরিত হন তখন তাঁহাদের মৃত্যুর ছায়া গোধূলির অন্ধকারের মতো সমস্ত দেশের উপর আসিয়া পড়ে। তাঁহাদের বিচ্ছেদজনিত অভাব সমাজের মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান হইতে থাকে।

আমাদের সমাজ সেরূপ ঘন নহে। কর্তব্যপরম্পরায় আকৃষ্ট হইয়া পরিবারের বাহিরে বিচরণ করিতে কেহ আমাদিগকে বাধ্য করে না। এবং আমাদের বহিঃসমাজে রমণীদের স্থান না থাকাতে সেখানে সামাজিকতা অত্যন্ত অসম্পূর্ণ। এরূপ অবস্থায় আমাদের দেশের বড়োলোকেরা আপন ঘরের বাহিরে যথেষ্ট এবং যথার্থ-রূপে পরিচিত ও নানা সম্বন্ধে বদ্ধ হইতে পারেন না। তাঁহারা সর্বদাই অন্তরালে থাকেন।

মানুষকে বাদ দিয়া কেবল মানুষের কাজটুকু গ্রহণ করা সাধারণের পক্ষে বড়ো দুঃসাধ্য। উপহারের সঙ্গে সঙ্গে যদি একটি স্নেহহস্ত দেখা যায় তবে সেই উপহারের মূল্য অনেক বাড়িয়া যায় এবং তাহার স্মৃতি হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়া যায়। মানুষের পক্ষে মানুষ বড়ো আদরের বড়ো আকাঙক্ষার ধন। মানবহৃদয় ও মানবজীবনের সহিত মিশ্রিত হইয়া যাহা আমাদের নিকট উপস্থিত হয় তাহা অতি সহজে এবং সানন্দে আমরা গ্রহণ করিতে পারি। যখন একটি সজীব মানবকণ্ঠ মধুরস্বরে গান করে তখন সেই গানের সৌন্দর্যের মধ্যে একটি ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানবহৃদয়ের জীবন্ত সম্পর্ক অনুভব করিয়া আমরা প্রবলতর আনন্দ সম্ভোগ করি– যন্ত্রের মধ্য হইতে অবিকল সেই সংগীত শ্রবণ করিলে আনন্দের অনেকটা হ্রাস হয়। তখন আমরা যন্ত্রবাদককে অথবা সংগীতরচয়িতাকে গানের ভাবোচ্ছ্বাসের সহিত জড়িত করিয়া থাকি। যেমন করিয়া হউক, কর্মের সহিত কর্তাকে অব্যবহিতভাবে দেখিলে কর্মটি সজীব সচেতন হইয়া উঠে এবং আমাদের চেতনার সহিত সহজে মিশ্রিত হয়।

এইজন্য কোনো কার্য আমাদের মনোরম বোধ হইলে তাহার কর্তার সহিত পরিচিত হইবার জন্য আমাদের আগ্রহ জন্মে। নতুবা আমাদের হৃদয় যেন তাহারা পুরা খাদ্যটি পায় না। তাহার অর্ধেক ক্ষুধা থাকিয়া যায়।

আমাদের দেশে সমাজ ভিন্ন ভিন্ন, জাতি ভিন্ন ভিন্ন পরিবার এবং অন্তঃপুর ও বহির্ভবনে বিচ্ছিন্নভাবে বিভক্ত হওয়াতে আমরা মানুষকে নিকটস্থ করিয়া দেখিতে পাই না; তাহার উপহার এবং উপকারগুলি দূর হইতে আমাদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হইতে থাকে– আমাদের প্রীতি ও কৃতজ্ঞতা কোনো- একটি সজীব মূর্তিকে অবলম্বন করিয়া আপনাকে সর্বদা সজাগ রাখিতে পারে না।

আমাদের দেশের মহৎ ব্যক্তিদিগকে যাঁহারা বন্ধুভাবে জানেন তাঁহারাই আমাদের এই আকাঙক্ষা তৃপ্ত, এই অভাব দূর করিতে পারেন। তাঁহারাই আমাদের আনন্দকে সম্পূর্ণতা দান করিতে পারেন। তাঁহারা উপকারের সহিত উপকারীকে একত্র করিয়া আমাদের সম্মুখে ধরিতে পারেন এবং সেই উপায়ে আমাদের কৃতজ্ঞতাকে সজীব করিয়া আমাদের হৃদয়ের গ্রহণশক্তি ধারণাশক্তিকে সতেজ করিয়া তুলিতে পারেন। কেবল শুষ্ক সমালোচন, কেবল সভাস্থলে ভাষার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিয়া কর্তব্যপালন নহে, মহাত্মা ব্যক্তির সহিত সর্বসাধারণের পরিচয়-সাধন করাইয়া দেওয়া একমাত্র বন্ধুর দ্বারাই সম্ভব। অর্থ এবং উৎসাহাভাবে আমাদের দেশের বড়োলোকদের প্রস্তরমূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় না বলিয়া মনে আক্ষেপ হয় কিন্তু তদপেক্ষা আক্ষেপের বিষয় এই যে, যাঁহারা তাঁহাদিগকে প্রস্তরমূর্তির অপেক্ষা সজীবতরভাবে আমাদের হৃদয়ে স্থাপিত করিতে পারেন তাঁহারা সে কর্তব্যকে যথেষ্ট গুরুতর মনে করেন না।

মৃত্যুর পরে এই বন্ধুকৃত্য অবশ্যপালনীয়।

সভাস্থলে মৃতবন্ধুর সম্বন্ধে আলোচনা করা অত্যন্ত কঠিন কার্য। এবং সে কর্তব্য-পালনে যদি কেহ কুণ্ঠিত হন তবে তাঁহাকে দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু লেখায় সে আপত্তি থাকিতে পারে না। যেমন আকারে হউক আমরা প্রিয়বন্ধুর হস্ত হইতে পাব্লিক-বন্ধুর প্রতিমূর্তি প্রত্যাশা করি।