পরিশিষ্ট

জীবনের যবনিকা অনেক সময় মনুষ্যকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। মৃত্যু যখন এই যবনিকা ছিন্ন করিয়া দেয় তখন মানুষ সমগ্রভাবে আমাদের নিকট প্রকাশ হয়। প্রতিদিন এবং প্রতিমুহূর্তের ভিতর দিয়া যখন আমরা তাহাকে দেখি তখন তাহাকে কখনো ছোটো কখনো বড়ো, কখনো মলিন কখনো উজ্জ্বল দেখিতে হয়। কিন্তু মৃত্যুর আকাশ ধূলিহীন স্বচ্ছ, নিমেষে নিমেষে তাহার পরিবর্তন নাই। সেই মৃত্যুর মধ্যে স্থাপন করিয়া দেখিলে মানুষকে কতকটা যথার্থভাবে দেখা যাইতে পারে।

যাঁহারা জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণ করিয়া থাকেন তাঁহারা বলেন, আমাদের চতুর্দিক্‌বর্তী বায়ুস্তর এই পর্যবেক্ষণের পক্ষে অত্যন্ত বাধাজনক। বিশেষত বায়ুর নিম্নস্তরগুলি সর্বাপেক্ষা অস্বচ্ছ। এইজন্য পর্বতশিখর জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণের পক্ষে অনুকূল স্থান।

মানব-জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণেও আমাদের চতুর্দিকস্থ বায়ুস্তরে অনেক বিঘ্ন দিয়া থাকে। আবর্তিত আলোড়িত সংসারে উড্ডীয়মান বিচিত্র অণুপরমাণু দ্বারা এই বায়ু সর্বদা আচ্ছন্ন। ইহাতে মহত্ত্বের আলোকরশ্মিকে স্থানভ্রষ্ট পরিমাণভ্রষ্ট করিয়া দেখায়। বর্তমানের এই আবিল বায়ুতে অনেক সময়ে কিরণরেখা অযথা বৃহৎ দেখিতেও হয়, কিন্তু সে বৃহত্ত্ব বড়ো অপরিস্ফুট – কিরণটিকে যথাপরিমাণে দেখিতে পাইলে হয়তো তাহার হ্রাস হইতে পারিত কিন্তু তাহার প্রস্ফুটতা উজ্জ্বলতা অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি পাইত।

মৃত্যু পর্বতশিখরের ন্যায় আমাদিগকে এই ঘন বায়ুস্তর হইতে স্বচ্ছ আকাশে লইয়া যায়, যেখানে মহত্ত্বের সমস্ত রশ্মিগুলি নির্মল অব্যাহতভাবে আমাদের দৃষ্টিপথে আসিয়া পড়ে।

এই মৃত্যুশিখরে বন্ধুদিগের সাহায্যে আমাদের জ্যোতিষ্কদিগের সহিত আমরা পরিচিত হইতে চাহি।

পরিচিত ব্যক্তিকে অন্যের নিকট পরিচিত করা কার্যটি তেমন সহজ নহে। জীবনের ঘটনার মুখ্য-গৌণ নির্বাচন করা বড়ো কঠিন। যিনি আমাদের নিকট সুপরিচিত তাঁহার কোন্‌ অংশ অন্যের নিকট পরিচয়সাধনের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযোগী তাহা বাহির করা দুরূহ। অনেক কথা অনেক ঘটনাকে সহসা সামান্য মনে হইতে পারে, পরিচয়ের পক্ষে যাহা সামান্য নহে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের অনেক ক্ষমতাশালী বন্ধু আছেন যাঁহাদের সমালোচনশক্তি নির্বাচনশক্তি গঠনশক্তি সামান্য নহে। সাহিত্যক্ষেত্রে বঙ্কিমের প্রতিমূর্তি স্থাপনের ভার তাঁহাদের লওয়া কর্তব্য। স্বভাবত কৃতঘ্ন বলিয়াই যে আমাদের পাব্লিক অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাহা নহে, সে ভালো করিয়া বোঝে না, সম্পূর্ণ রূপে জানে না বলিয়াই তাহার কৃতজ্ঞতা জাগ্রত হইয়া উঠে না। মৃত ব্যক্তির কার্যগুলি ভালো করিয়া দেখাইয়া দিতে হইবে এবং তাঁহাকে আমাদের মধ্যে আনিয়া উপস্থিত করিতে হইবে। লেখক বলিয়া নহে, কিন্তু স্নেহপ্রীতিসুখদুঃখে মনুষ্যভাবে তাঁহার লেখার সহিত এবং আমাদের সহস্রের সহিত তাঁহাকে সংযুক্ত করিয়া দিতে হইবে। তাঁহাকে কেবল দেবতা বলিয়া পূজা করা নহে, কিন্তু স্বজাতীয় বলিয়া আমাদের আত্মীয় করিয়া দিতে হইবে।

আমার আমাদের মহৎব্যক্তিদিগকে দেবলোকে নির্বাসিত করিয়া দিই। তাহাতে আমাদের মনুষ্যলোক দরিদ্র এবং গৌরবহীন হইয়া যায়। কিন্তু তাঁহারা যদি রক্তমাংসের মনুষ্যরূপে সুনির্দিষ্ট-পরিচিত হন, সহস্র ভালোমন্দের মধ্যেও আমরা যদি তাঁহাদিগকে মহৎ বলিয়া জানিতে পারি তবেই তাঁহাদের মনুষ্যত্বের অন্তর্নিহিত সেই মহত্ত্বটুকু আমরা যথার্থ অন্তরের সহিত গ্রহণ করিতে পারি, তাঁহাকে ভালোবাসি এবং বিস্মৃত হই না।

এ কাজ কেবল বন্ধুরাই করিতে পারেন। এবং বন্ধুগণ যখন প্রস্তরমূর্তিস্থাপনে উদাসীন পাব্লিককে অকৃতজ্ঞ বলিয়া তিরস্কার করিতেছেন তখন পাব্লিকও তাঁহাদের প্রতি অকৃতজ্ঞতার অভিযোগ আনিতে পারেন। কারণ, তাঁহারা বঙ্কিমের নিকট হইতে কেবলমাত্র উপকার পান নাই, বন্ধুত্ব পাইয়াছেন, তাঁহারা কেবল রচনা পান নাই, রচয়িতাকে পাইয়াছেন। অর্থ থাকিলে প্রস্তরমূর্তি স্থাপন করা সহজ, কিন্তু বঙ্কিমকে বন্ধুভাবে মনুষ্যভাবে মনুষ্যলোকে প্রতিষ্ঠিত করা কেবল তাঁহাদেরই প্রীতি এবং চেষ্টা-সাধ্য। তাঁহাদের বন্ধুকে কেবল তাঁহাদের নিজের স্মরণের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিলে যথার্থ বন্ধুঋণ শোধ করা হইবে না।