ছন্দের অর্থ
ব্যাকুল বকুল ঝরিল পড়িল ঘাসে,
বাতাস উদাস আমের বোলের বাসে।

পাঁচ-চার-পাঁচের ভাগ–

নীরবে গেলে ম্লানমুখে আঁচল টানি,
কাঁদিছে দুখে মোর বুকে না-বলা বাণী।

এই শ্লোককেই তিন-ছয়-পাঁচ ভাগ করা যায়–

নীরবে গেলে ম্লানমুখে আঁচল টানি,
কাঁদিছে দুখে মোর বুকে না-বলা বাণী।
এর থেকে এই বোঝা যাচ্ছে, প্রদক্ষিণের সমষ্টিমাত্রা চোদ্দ হলেও সেই সমষ্টির অংশের হিসাব কে কী ভাবে নিকাশ করছে তারই উপর ছন্দের প্রভেদ ধরা পড়ে। কেবল ছন্দরসায়নে নয়,বস্তুরসায়নেও এইরকম উপাদানের মাত্রা-ভাগ নিয়েই বস্তুর প্রকৃতিভেদ ঘটে, রাসায়নিকেরা বোধ করি এই কথা বলেন।

পয়ার-ছন্দের বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, তাকে প্রায় গাঁঠে গাঁঠে ভাগ করা চলে, এবং প্রত্যেক ভাগেই মূল ছন্দের একটা আংশিক রূপ দেখা যায়। যথা–

ওহে পান্থ, চলো পথে, পথে বন্ধু আছে
একা বসে ম্লানমুখে, সে যে সঙ্গ যাচে।

‘ওহে পান্থ’, এইখানে একটা থামবার স্টেশন মেলে। তার পরে যথাক্রমে, ‘ওহে পান্থ চলো’, ‘ওহে পান্থ চলো পথে’, ‘ওহে পান্থ চলো পথে পথে’। তার পরে ‘বন্ধু আছে’, এই ভগ্নাংশটার সঙ্গে পরের লাইন জোড়া যায়, যেমন– ‘বন্ধু আছে একা’, ‘বন্ধু আছে একা বসে’, ‘বন্ধু আছে একা বসে সে যে’। কিন্তু তিনের ছন্দকে তার ভাগে ভাগে পাওয়া যায় না, এইজন্যে তিনের ছন্দে ইচ্ছামতো থামা চলে না। যেমন, ‘নিশি দিল ডুব অরুণসাগরে’। ‘নিশি দিল’, এখানে থামা যায়, কিন্তু তাহলে তিনের ছন্দ ভেঙে যায়; ‘নিশি দিল ডুব’ পর্যন্ত এসে ছয় মাত্রা পুরিয়ে দিয়ে তবেই তিনের ছন্দ হাঁফ ছাড়তে পারে। কিন্তু আবার, ‘নিশি দিল ডুব অরুণ’ এখানেও থামা যায় না; কেননা তিন এমন একটি মাত্রা যা আর একটা তিনকে পেলে তবে দাঁড়াতে পারে, নইলে টলে পড়তে চায়; এইজন্য ‘অরুণসাগর’এর মাঝখানে থামতে গেলে রসনা কূল পায় না। তিনের ছন্দে গতির প্রাবল্যই বেশি, স্থিতি কম। সুতরাং তিনের ছন্দ চাঞ্চল্যপ্রকাশের পক্ষে ভালো কিন্তু তাতে গাম্ভীর্য এবং প্রসার অল্প। তিনের মাত্রার ছন্দে আমিত্রাক্ষর রচনা করতে গেলে বিপদে পড়তে হয়, সে যেন চাকা নিয়ে লাঠিখেলার চেষ্টা। পয়ার আট পায়ে চলে বলে তাকে যে কত রকমে চালানো যায় মেঘনাদবধকাব্যে তার প্রমাণ আছে। তার অবতারণাটি পরখ করে দেখা যাক। এর প্রত্যেক ভাগে কবি ইচ্ছামতো ছোটো বড়ো নানা ওজনের নানা সুর বাজিয়েছেন; কোনো জায়গাতেই পয়ারকে তার প্রচলিত আড্ডায় এসে থামতে দেন নি। প্রথম আরম্ভেই বীরবাহুর বীরমর্যাদা সুগম্ভীর হয়ে বাজল– ‘সম্মুখসমরে পড়ি বীরচূড়ামণি বীরবাহু’। তার পরে তার অকালমৃত্যুর সংবাদটি যেন ভাঙা