রাজা
অন্ধকার ঘর
রানী সুদর্শনা ও তাঁহার দাসী সুরঙ্গমা

সুদর্শনা। আলো, আলো কই। এ ঘরে কি একদিনও আলো জ্বলবে না।

সুরঙ্গমা। রানীমা, তোমার ঘরে-ঘরেই তো আলো জ্বলছে— তার থেকে সরে আসবার জন্যে কি একটা ঘরেও অন্ধকার রাখবে না।

সুদর্শনা। কোথাও অন্ধকার কেন থাকবে।

সুরঙ্গমা। তা হলে যে আলোও চিনবে না, অন্ধকারও চিনবে না।

সুদর্শনা। তুই যেমন এই অন্ধকার ঘরের দাসী তেমনি তোর অন্ধকারের মতো কথা, অর্থই বোঝা যায় না। বল্‌ তো এ ঘরটা আছে কোথায়। কোথা দিয়ে এখানে আসি, কোথা দিয়ে বেরোই, প্রতিদিনই ধাঁদা লাগে।

সুরঙ্গমা। এ ঘর মাটির আবরণ ভেদ করে পৃথিবীর বুকের মাঝখানে তৈরি। তোমার জন্যেই রাজা বিশেষ করে করেছেন!

সুদর্শনা। তাঁর ঘরের অভাব কী ছিল যে এই অন্ধকার ঘরটা বিশেষ করে করেছেন!

সুরঙ্গমা। আলোর ঘরে সকলেরই আনাগোনা— এই অন্ধকারে কেবল একলা তোমার সঙ্গে মিলন।

সুদর্শনা। না না, আমি আলো চাই— আলোর জন্যে অস্থির হয়ে আছি। তোকে আমি আমার গলার হার দেব যদি এখানে একদিন আলো আনতে পারিস।

সুরঙ্গমা। আমার সাধ্য কী মা— যেখানে তিনি অন্ধকার রাখেন আমি সেখানে আলো জ্বালব!

সুদর্শনা। এত ভক্তি তোর! অথচ শুনেছি, তোর বাপকে রাজা শাস্তি দিয়েছেন। সে কি সত্যি।

সুরঙ্গমা। সত্যি। বাবা জুয়ো খেলত। রাজ্যের যত যুবক আমাদের ঘরে জুটত—মদ খেত আর জুয়ো খেলত।

সুদর্শনা। তুই কী করতিস।

সুরঙ্গমা। মা, তবে সব শুনেছ। আমি নষ্ট হবার পথে গিয়েছিলমুম। বাবা ইচ্ছে করেই আমাকে সে পথে দাঁড় করিয়েছিলেন। আমার মা ছিল না।

সুদর্শনা। রাজা যখন তোর বাপকে নির্বাসিত করে দিলেন তখন তোর রাগ হয় নি?

সুরঙ্গমা। খুব রাগ হয়েচিল — ইচ্ছে হয়েছিল, কেউ যদি রাজাকে মেরে ফেলে তো বেশ হয়।

সুদর্শনা। রাজা তোর বাপের কাছ থেকে ছাড়িয়ে এনে কোথায় রাখলেন?

সুরঙ্গমা। কোথায় রাখলেন কে জানে। কিন্তু কী কষ্ট গেছে! আমাকে যেন ছুঁচ ফোটাত, আগুনে পোড়াত।

সুদর্শনা। কেন, তোর এত কষ্ট কিসের ছিল।

সুরঙ্গমা। আমি নষ্ট হবার পথে গিয়েছিলুম— সে পথ বন্ধ হতেই মনে হল আমার যেন কোনো আশ্রয়ই রইল না। আমি কেবল খাঁচায়-পোরা বুনো জন্তুর মতো কেবল গর্জে বেড়াতুম এবং সবাইকে আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করত।