নিন্দা-তত্ত্ব
কুশ্রীত্ব তোমার মনে তেমন আঘাত দেয়। সুশিক্ষার গুণে সৌন্দর্যপ্রিয়তা যখন তোমার মনে যথেষ্ট বিকসিত হবে, তখন একটা কদাচরণের কথা শুনলে ঘৃণায় তোমার গা শিউরে উঠবে কিংবা লজ্জা ও সংকোচে তোমার মাথা হেঁট হয়ে যাবে বটে কিন্তু সেই কথা শুনে তোমারআমোদ বোধ হবে না, বা সেই কথা নিয়ে অবকাশের সময় বৈঠকখানায় বসে দশ জনের কাছে দশটা রসিকতা ও হাস্য-পরিহাস করতে রুচি হবে না। কিন্তু সৌন্দর্যের ভাব কজন লোকের মনে এমন প্রস্ফুটিত?

নিন্দা বিশ্বাস করবার দিকে আমাদের কেমন একটা টান আছে। একটা নিন্দা শুনলে আমরা প্রায় তার প্রমাণ জিজ্ঞাসা করি নে, আসল কথা হচ্ছে জিজ্ঞাসা করতে চাই নে। বোধ হয় আমাদের মনে মনে এক প্রকার সূক্ষ্ম ভয় থাকে, পাছে তার ভালো প্রমাণ না থাকে। নিন্দা বিশ্বাস করবার দিকে সাধারণের এত অনুরাগ যে, চণ্ডীমণ্ডপের বিচারালয়ে নিন্দিত ব্যক্তি অপেক্ষা নিন্দুকের সাক্ষী অধিকতর প্রামাণ্য বলে গৃহীত হয়। তুমি রাধামাধবের নামে আমার কাছে একটা দোষোত্থাপন করলে, আমি কোনো প্রমাণ না জিজ্ঞাসা করেও তা বিশ্বাস করলেম, তার পরে রাধামাধব যদি বলতে আসে যে, আমি কোনো দোষ করি নি, তা হলে আমি হয়তো প্রমাণ না পেলে তা ঝট্‌ করে বিশ্বাস করি নে। নিন্দিত ব্যক্তির অত্যন্ত সংকটের অবস্থা। আমরা সহজেই মনে করি, যে দোষী ব্যক্তি তো স্বভাবতই আপনার দোষ ক্ষালন করতে চেষ্টা পাবেই। সুতরাং আমরা তার কথায় কান দিই নে। অনেক সময়ে ‘দোষ করি নি’ ছাড়া আমাদের আর কিছু বক্তব্য থাকে না, আমরা অনেক সময়ে বিশেষ কতকগুলি গোপনীয় কারণে নির্দোষিতার প্রমাণ থাকতেও তা আমরা প্রমাণ করতে পারি নে। এ রকম অবস্থায় দায়ে পড়ে ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’ হয়ে পড়েন। আমরা যে নিন্দা বিশ্বাস করতে ভালোবাসি তার আর-একটা প্রমাণ এই যে, মনে করো হরিহর রামধনের নামে তোমার কাছে একটা নিন্দা করেছে, তুমি সেটা বিশ্বাস করেছ ও সেই অবধি পরম আমোদে আছ, এবং দু-দশ জন বন্ধুর কাছে গল্প করেছ; আমি যদি আজ এসে তোমাকে বলি যে, হরিহর লোকটা অত্যন্ত নিন্দুক, তার কথা বিশ্বাস করবার যোগ্য নয়, তা হলে তুমি কোনোমতে তা বিশ্বাস কর না, তুমি বলো,‘না, না, তা কি হয়? লোকটা কি একেবারে খাঁটি মিথ্যে কথা বলতে পারে?’ কী আশ্চর্য! হরিহরের মুখে তুমি যখন রামধনের নিন্দের কথা শুনেছিলে, তখন তো তুমি প্রশংসনীয় উদারতার সঙ্গে বল নি যে,‘না, না, তা কি হয়! সে লোকটা কি এমন কাজ করতে পারে?’ একটা নিন্দা তুমি অতি সহজে গলাধঃকরণ করলে, কিন্তু আর-একটা সেই শ্রেণীর নিন্দেই কেন তোমার গলায় হঠাৎ বাধল? এর কারণ অবশ্য সকলেই বুঝতে পারছেন। তিনি পরম আনন্দে একটি সুস্বাদ নিন্দা উপভোগ করছিলেন, আর তুমি কি না আর-একটি নীরস নিন্দা তাঁর হাতে দিয়ে সেটি তাঁর মুখ থেকে কেড়ে নিতে চাও? যে নিন্দুকের মুখ থেকে তিনি অমৃত পান করেন, তাকে তুমি আর যা খুশি বলে নিন্দে করো, কিন্তু মিথ্যেবাদী বলে খবরদার নিন্দে কোরো না, তা হলে তুমিই মিথ্যেবাদী হয়ে দাঁড়াবে।

বিশ্বাস-পরায়ণতা মনের সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থা। যাঁরা পরনিন্দা শুনলে অতি সহজেই তা বিশ্বাস করেন, তাঁদের হয়তো তুমি বিশ্বাস-পরায়ণ বলবে। আমি তো ঠিক তার উল্টো বলি। যেমন তুমি যখন বল, আমি চার দিক অন্ধকার দেখছি, তখন তার অর্থ বোঝায়, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি নে, অর্থাৎ অন্ধকার দেখা, কিছু না-দেখার ভাষান্তর মাত্র, তেমনি নিন্দা-বিশ্বাসিতা, অবিশ্বাসিতার অন্য একটি নাম। তুমি দেখতে পাবে, সন্দিগ্ধ ও কুটিল হৃদয়েরাই নিন্দা নিয়ে লেনা-দেনা করে থাকেন। তুমি যথার্থ সরল ও অসন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তির কাছে কারও নিন্দা উত্থাপন করো, তিনি বলে উঠবেন,‘না, না, এমনও কি মানুষে করতে পারে।’ মানুষের চরিত্রের উপর তাঁর এত বিশ্বাস যে, তিনি, কেহ যে খারাপ কাজ করেছে, তা শীঘ্র বিশ্বাস করতে পারেন না। মনে করো, তোমার এক পরিচিত ব্যক্তি অত্যন্ত ধার্মিক, তাঁকে তুমি প্রত্যহ দুই সন্ধে দেবপূজা করতে দেখ, আমি তোমাকে একদিন কানে কানে ফুসফুস করে বললেম যে, চক্রবর্তীমশায় বৃহস্পতিবারে গোমাংস খেয়েছেন, অমনি তুমি তা বিশ্বাস করলে; তুমি কতদূর সন্দিগ্ধহৃদয় বলো দেখি! তুমি প্রত্যহ নিজের চক্ষে তাঁর ধার্মিকতার প্রমাণ পাচ্ছ, আরেকদিন একটা কানে কানে কথা শুনেই সে-সমস্ত তুমি