নিন্দা-তত্ত্ব
অবিশ্বাস করলে? চণ্ডীমণ্ডপে গুটিপাঁচেক বৃদ্ধ গৃহস্বামী বসে ধূম-সেবন করছেন, চাণক্যের শ্লোক পাঠ করে ও বয়ঃপ্রাপ্তি অবধি চণ্ডীমণ্ডপের তাম্রকূটধূমাচ্ছন্ন ও নস্যগন্ধী পর-চর্চা শুনে সংসারের বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা অসাধারণ পক্বতা প্রাপ্ত হয়েছে; রামশংকর খুড়ো তাঁদের এসে বললেন যে, মণ্ডলদের বাড়ির ছোটো বউ সমাজ-বিরুদ্ধ কাজ করেছে, তাঁরা অতি অল্প পরিশ্রমে সমস্ত সিদ্ধান্ত করে মহা বিজ্ঞভাবে বললেন যে, ‘কিছু আশ্চর্য নয়, কারণ, ‘‘বিশ্বাসং নৈব কর্তব্যং স্ত্রীষু রাজকুলেষু চ’’।’ তাই তো বলি, নিন্দা বিশ্বাস করা সন্দিগ্ধ হৃদয়ের লক্ষণ। তবে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা দূর অপেক্ষা আশু, অনুপস্থিত অপেক্ষা উপস্থিত, ও নিজের চোখের দেখা অপেক্ষা পরের মুখের কথা অধিক বিশ্বাস করেন। এখন তুমি তাঁকে একটি খবর দেও, তা বিশ্বাস করতে তাঁর যত পরিশ্রম ও সময় ব্যয় হবে, দু ঘণ্টা পরে আর-এক জন ঠিক তার বিপরীত খবর দিলে, তা বিশ্বাস করতে তাঁর তার চেয়ে কিছু অধিক হবে না। এমন লোকের শিশু-প্রকৃতির একটা ঘোরতর ভ্রমের ফল। এ দলের সম্বন্ধে আমার অধিক কিছু বক্তব্য নেই। নিন্দা অবিশ্বাস করবার ঝোঁক অনেকটা শিক্ষা ও অভ্যাস -সাপেক্ষ। এ বিষয়ে বিশেষ অভ্যাস ও বিবেচনা আবশ্যক। যে নিন্দা শুনলে তোমার মনে কষ্ট হয়, তা তুমি না বিশ্বাস করতেও পার, কিংবা যে নিন্দায় তোমার কষ্ট বা সুখ কিছুই না জন্মায়, তা তুমি বিশেষ প্রমাণ না পেলে অবিশ্বাস করতে পার, কিন্তু স্বার্থজড়িত কতকগুলি বিশেষ কারণে যে নিন্দা শুনলে তোমার আমোদ জন্মাবার সম্ভাবনা, তা বিশেষ প্রমাণ না পেয়ে বিশ্বাস না করা শিক্ষিত মনের লক্ষণ। আর-এক অবস্থায় আমরা নিন্দা অতি সহজে বিশ্বাস করি। আমরা একজন লোককে খারাপ বলে জানি, তার নামে একটা নিন্দা শুনবামাত্রেই আমরা অনায়াসে বিশ্বাস করি, আমরা মনে করি এটা কিছুই অসম্ভব নয়। সুতরাং আমরা তার আর প্রমাণ জিজ্ঞাসা করি নে কিন্তু শিক্ষিতমনা ব্যক্তিরা তখন বলেন যে,‘সমস্ত সম্ভব ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে না।’ একটা জিনিস সম্ভব হতে পারে কিন্তু সত্য নাও হতে পারে। এক ব্যক্তি এসে যখন আমাদের কাছে একটা প্রিয়-নিন্দা উত্থাপন কঞ্চরে বলে যে, ‘এইরকম তো সকলে বলছে!’ তখন আমরা আর কিছু বিচার করি নে, মনে করি ‘সকলে বলছে’, এর চেয়ে সুদৃঢ় প্রমাণ আর কিছুই হতে পারে না! কিন্তু, এই ‘সকলে বলছে’ কথাটি অত্যন্ত শূন্যগর্ভ। একজন তোমাকে এসে বললেন, সকলে বলছে অমুকে অমুক কাজ করেছে। সেখেনে ‘সকলে’চ অর্থে তিনি যে ব্যক্তির মুখে শুনেছেন, তুমি তাঁর ধুয়ো ধরে আমাকে বললে যে, সকলে অমুক কথা বলছে। আমি অকাতরে বিশ্বাস করি যে, যখন ‘‘সকলে বলছে’’তখন অবিশ্যি সত্যি! আমাকে একজন এসে যদি জিজ্ঞাসা করে যে, ‘তুমি যে বলছ ‘সকলে বলছে’, আচ্ছা, কে কে বলছে বলো দেখি?’আমি ভেবে ভেবে একজনের বেশি নাম করতে পারি নে, অবশেষে অপ্রস্তুত হয়ে আমি তোমাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি-- ‘ওহে,কে কে বলছে বলো দেখি?’ তুমিও তথৈবচ। মূল অন্বেষণ করতে যতদূর পর্যন্ত যাও-না কেন, দেখবে তোমার চেয়ে এ বিষয়ে কারও জ্ঞান অধিক নয়। ‘সকলে বলছে’ কথাটা একটা সংক্রামক পীড়া। প্রথমত একজনের মুখ থেকে কথাটা বেরোয়, তার পরে দিবসান্তে সকলেরই মুখে শুনতে পাবে ‘সকলে বলছে।’সকালবেলায় যে কথাটি সম্পূর্ণ অলীক ছিল, সন্ধেবেলায় সেটা সম্পূর্ণ সত্য হয়ে দাঁড়ায়। আমি একটা বিশেষ নিয়ম করেছি যে, ‘সকলে বলছে’কথাটি যখনি শুনব, তখনি জিজ্ঞাসা করব ‘কে কে বলছে?’

শিক্ষিত ব্যক্তিরা যখন একটা নিন্দা শোনেন তখন অনেক রকম বিচার করেন। আমরা তিন রকম ব্যক্তির কাছে নিন্দা শুনি : ১. বিখ্যাত নিন্দুক অর্থাৎ যাদের আমরা নিন্দুক বলে জানি। ২. যাদের বিষয়ে আমরা কিছুই অবগত নই। ৩. যাদের আমরা সত্যবাদী বলে জানি। প্রথমোক্ত ব্যক্তিদের মুখ থেকে যখন শিক্ষিতমনা ব্যক্তি কোনো নিন্দা শোনেন তখন তা অবিশ্বাস করতে তাঁর বড়ো পরিশ্রম হয় না। দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তির মুখ থেকে যখন শোনেন তখন তাঁর একটা ভাবনা আসে; হয়তো মনে করেন যে, ‘এ লোকটার কথা অবিশ্বাস করবার আমার কী অধিকার আছে?’ কিন্তু এ ভাবনা কোনো কাজের নয়, কেননা তখন আমাদের দুটো বিরোধী কর্তব্যের সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। আর-এক জনের সচ্চরিত্রে অবিশ্বাস করবার আমার কী অধিকার আছে? এ রকম অবস্থায় তিনি বিশ্বাসও করেন না অবিশ্বাসও করেন না। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দুইয়েরই অধিকার-বহির্ভূত একটি দাঁড়াবার স্থান আছে। তিনি তখন