প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
‘হেরে আচম্বিতে এ ঘোর সংকটে,
ভয়ংকর ছায়া আকাশের পটে,
ছিল যত তারা তাহার নকটে
ক্রমে ম্লান হয়ে গেল নিবিয়া।*
সে ছায়া পশিল কাননে — অমনি,
পলায় শ্বাপদ, উঠে পদধ্বনি,
বৃক্ষ শাখা কত ভাঙিল আপনি,
সতী ধরে শবে বুকে আটিয়া॥
কিন্তু গ্রন্থকার যে সত্যবানকে জীবন দান না করিয়া সাবিত্রীকে পর্যন্ত মারিয়া ফেলিলেন কেন—তাহা তো আমরা বুঝিতে পারি না। কোথায় সতীত্বের অমোঘ প্রভাবে যমহস্ত হইতেও পতিব্রতা সতী মৃত স্বামীকে ফিরিয়া লইবেন—না সাবিত্রীও এ দেশীয় শত সহস্র স্ত্রীর মতো যমের নিকটে সহমরণের বর প্রার্থনা করিয়া পতির সঙ্গেই সহমরণে অন্তর্ধান হইলেন। যদি কোনো পুরাণে এরূপ কথা থাকিত তা হইলেও বুঝিতাম যে গ্রন্থকার কী করিবেন—কিন্তু তাহা নয়, বঙ্কিমবাবু স্বেচ্ছামতো পুরাণের উৎকর্ষ সাধন করিতে গিয়া একটি অতি সুন্দর কাহিনীর সুন্দরতম অংশটুকু একেবারে মৃত্তিকাসাৎ করিয়াছেন। আমরা স্বীকার করি যে স্বামীর সহিত ইচ্ছাপূর্বক হমরণে যাওয়া বিশেষ অনুরাগের লক্ষণ। কিন্তু তাহা মহান সতীত্বের পরাকাষ্ঠা নহে;— অসতীর অগ্রগণ্যা ক্লিয়োপেট্রাও আন্টনির মৃত্যুর পর ইচ্ছাপূর্বক জীবন বিসর্জন করিয়াছিলেন—তিনিও মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে ইরাস্ নামক সহচরীকে সম্বোন্ধন করিয়া বলিয়াছিলেন ‘ত্বরায়— ত্বরায়— রে শান্ত ইরাস্— আর বিলম্ব করিস না— আমি যেন শুনিতে পাইতেছি আমাকে আন্টনি ডাকিতেছেন, আমি যেন দেখিতে পাইতেছি তিনি আমার এই আত্ম-বিসর্জনরূপ মহৎ কার্য দেখিবার জন্য জাগিয়া উঠিতেছেন’। স্বীকার করি যে এ কথাগুলি শেক্সপিয়রের, কিন্তু শেক্সপিয়র ইতিহাসের মূলোচ্ছেদ করিয়া কপোলকল্পিত কতকগুলি প্রলাপ বাক্য কহেন নাই—তিনি ইতিহাসকে অক্ষুন্ন রাখিয়াও কল্পনা-প্রাচুর্য খুবই দেখাইয়াছেন—বঙ্কিমবাবু বিপরীত প্রথা অবলম্বন করিয়া বিপরীত ফল উৎপাদন করিয়াছেন। কেহ কেহ বলিতে পারেন যে আন্টনি ক্লিয়োপেট্রার স্বামী ছিল না—কিন্তু তাহাতে কী এলো গেল—তাহাতে আরও সপ্রমান হইতেছে যে সতী স্ত্রী না হইলেও অনুরাগের ঝোঁকে এক জন অসতীও সহমরণে যাইতে পারে; মনে করো—ক্লিয়োপেট্রার শেষ দশায় যখন আন্টনির সহিত প্রণয় হইল—তখন আন্টনির যদি বিবাহই হইত, তাহা হইলেই কি ক্লিয়োপেট্রার পূর্বের বেশ্যাবৃত্তি ভুলিয়া তাঁহার ইচ্ছামৃত্যু দেখিয়াই তাঁহাকে সতী ও পতিব্রতা কহিতাম?—সহমরণে যাওয়াই কি সাবিত্রীর অলৌকিক পাতিব্রত্যের পরাকাষ্ঠা মনে করিতে হইবে?—পুরাণে তাহা বলে না। পুরাণে এই কথাই বলে যে সাবিত্রী আপনার সতীত্ব-প্রভাবে উত্তেজিত হইয়া এই সংকল্প করিলেন যে সতীত্বের অলৌকিক মাহাত্ম্যে যমের হস্ত হইতে পর্যন্ত আমার মৃত স্বামিকে ফিরাইয়া আনিব। সেই সংকল্প অনুসারে তিনি একাকিনী চতুর্দশীর ভীষণ নিশীথ-যোগে বিকট অরণ্যে মৃত পতিকে ক্রোড়ে লইয়া যমরাজের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন—যমরাজ সাবিত্রীকে দেখিয়া প্রীত হইলেন—প্রীত হইয়া অবশেষে সত্যবানকে সতী স্ত্রীর আলিঙ্গনে প্রত্যর্পণ করিলেন।– পুরাণের এ কথা কেহ বিশ্বাস করিবেন না বটে, কিন্তু ইহার ভিতর একটি ভাব আছে—এবং সেই ভাবের প্রভাবে সাবিত্রীর গল্পটি ভারতবাসিনীদের হৃদয়ের শিরা এবং উপশিরায় ঘোর ঘনিষ্ঠ ভাবে বিজড়িত আছে। দুই-তিন সহস্র সতী স্ত্রী মৃত পতির সহিত সহমরণে গিয়াছে—কিন্তু কেহই তাহাদের সহমরণকে সতীত্বের যারপরনাই মাহাত্ম্য লক্ষণ মনে করে না।