যোগাযোগ

কুমুদিনী। দাদা, আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমার যেন কোথায় যেতে ইচ্ছে করছে।

বিপ্রদাস। ভুল বলছিস কুমু। তোর ভালোই লাগবে। আর কিছুদিন পরেই তোর মন উঠবে ভরে।

কুমুদিনী। কিন্তু তা হলে —

বিপ্রদাস। তা জানি — এখন তোর বন্ধন কাটাবে কে?

কুমুদিনী। তবে কি যেতে হবে দাদা?

বিপ্রদাস। তোকে নিষেধ করতে পারি এমন অধিকার আর আমার নেই। তোর সন্তানকে তার নিজের ঘর-ছাড়া করব কোন্‌ স্পর্ধায়?

কুমুদিনী। তা হলে কবে যেতে হবে?

বিপ্রদাস। কালই, আর দেরি সইবে না।

কুমুদিনী। দাদা, একটা কথা বোধহয় বুঝতে পারছ, এবার গেলে ওরা আমাকে আর কখনো তোমার কাছে আসতে দেবে না।

বিপ্রদাস। তা আমি খুবই জানি।

কুমুদিনী। আচ্ছা, তাই হবে। কিন্তু তোমাকে বলে রাখি, কোনোদিন কোনো কারণেই তুমি ওদের বাড়ি যেতে পারবে না। জানি দাদা, তোমাকে দেখবার জন্যে আমার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠবে, কিন্তু ওদের ওখানে যেন কখনো তোমাকে না দেখতে হয়। সে আমি সইতে পারব না।

বিপ্রদাস। না, কুমু, সেজন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না।

কুমুদিনী। ওরা কিন্তু তোমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে।

বিপ্রদাস। ওরা যা করতে পারে তা করা শেষ হলেই আমার উপর ওদের ক্ষমতাও শেষ হবে। তখনি আমি হব স্বাধীন। তাকে তুই বিপদ বলছিস কেন?

কুমুদিনী। দাদা, সেই দিন তুমিও আমাকে স্বাধীন করে নিয়ো। ততদিনে ওদের ছেলেকে আমি ওদের হাতে দিয়ে যাব। এমন কিছু আছে যা ছেলের জন্যেও খোওয়ানো যায় না।

বিপ্রদাস। আচ্ছা — আগে হোক ছেলে, তার পরে বলিস।

কুমুদিনী। তুমি বিশ্বাস করছ না, মানুষ যখন মুক্তি চায় তখন কিছুতেই তাকে ঠেকাতে পারে না। আমি তোমারই বোন, দাদা, আমি মুক্তি চাই। একদিন বাঁধন কাটব, এই আমি তোমাকে বলে রাখলুম।

বিপ্রদাস। বাঁধন তোর ভিতরে কেটেছে। বাইরের বাঁধন তো মায়া।

কুমুদিনী। আমাকে ওরা ইচ্ছে করে দুঃখ দিয়েছে তা মনে কোরো না। আমাকে সুখ ওরা দিতে পারে না, আমি এমনি করেই তৈরি। আমিও তো পারব না ওদের সুখী করতে। যারা সহজে ওদের সুখী করতে পারে তাদের জায়গা জুড়ে কেবল একটানা একটা মুশকিল বাধবে। তা হলে কেন এ বিড়ম্বনা! সমাজের কাছ থেকে অপরাধের সমস্ত লাঞ্ছনা আমিই একলা মেনে নেব, ওদের গায়ে কোনো কলঙ্ক লাগবে না। কিন্তু একদিন ওদেরকে মুক্তি দেব, আমিও মুক্তি নেব, চলে আসবই — এ তুমি দেখে নিয়ো। মিথ্যে হয়ে মিথ্যের মধ্যে থাকতে পারব না। আমি ওদের বড়োবউ, তার কি কোনো মানে আছে যদি আমি কুম না হই?

বিপ্রদাস। ওদের বড়োবউ হওয়ার হীনতাও তোকে স্পর্শ করতে পারবে না। সোনায় কি কখনো মরচে ধরে?

কুমুদিনী। আজ সমস্ত দিন ধরেই এই কথা ভাবছি যে, চারি দিকে এত এলোমেলো, এত উল্‌টো-পাল্‌টা, তবু এ সমস্তকে ছাড়িয়ে গিয়েও চন্দ্রসূর্যকে নিয়ে সংসারের কাজ চলছে। তোমার কাছে এ-সব কথা বলতে লজ্জা করে — কিন্তু আর তো কখনো বলা হবে না, আজ বলে যাই। নইলে আমার জন্যে মিছিমিছি ভাববে। সমস্ত গিয়েও তবু বাকি থাকে, এই কথাটা বুঝতে পেরেছি ; সেই আমার অফুরান, সেই আমার দেবতা। এ যদি না বুঝতাম তা হলে এইখানে তোমার পায়ে মাথা ঠুকে মরতুম, সে গারদে ঢুকতাম না। দাদা, এ সংসারে তুমি আমার আছ, এ কথাটাকে তো কোনো কিছুতেই মিথ্যে করতে পারবে না — তা আমি তোমার কাছেই থাকি আর দূরেই থাকি।