চণ্ডালিকা
দেখি তুই শিবনেত্র, কাঠের মতো বসে, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে, জ্ঞান নেই। মনে হল, তোর মধ্যেও কোনোখানে দাউ-দাউ জ্বলছে আগুন। যে পাবক দিয়ে তিনি ঢেকেছেন আপনাকে তোর অগ্নিনাগিনী ফোঁস্‌ ফোঁস্‌ ক’রে তাকে ছোবল মারছে, চলছে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। ফিরে এসে আয়না তুলে দেখি, আলো গেছে—শুধু দুঃখ দুঃখ দুঃখ, অসীম দুঃখের মূর্তি।

মা। মরে পড়ে গেলি নে তাই দেখে! তারই তো ঝলক লেগেছিল আমার প্রাণের মধ্যে; মনে হল, আর সইবে না।

প্রকৃতি। যে দুঃখের রূপ দেখেছি সে তো তাঁর একলার নয়, সে আমারও; আমাদের দুজনের। ভীষণ আগুনে গলে মিশেছে সোনার সঙ্গে তাঁবা।

মা। ভয় হল না তোর মনে?

প্রকৃতি। ভয়ের চেয়ে অনেক বেশি— মনে হল দেখলুম, সৃষ্টির দেবতা প্রলয়ের দেবতার চেয়ে ভয়ংকর—আগুনকে চাবকাচ্ছেন তাঁর কাজে, আর আগুন কেবলই গোম্‌রাচ্ছে গর্জাচ্ছে। সপ্তধাতুর কৌটোতে কী আছে তাঁর পায়ের সামনে— প্রাণ না মৃত্যু? আমার মনে ফুলতে লাগল একটা আনন্দ। তাকে কী বলব? নতুন সৃষ্টির বিরাট বৈরাগ্য। ভাবনা নেই, ভয় নেই, দয়া নেই, দুঃখ নেই— ভাঙছে, জ্বলে উঠছে, গলে যাচ্ছে, ছিটকে পড়ছে স্ফুলিঙ্গ। থাকতে পারলুম না, আমার সমস্ত শরীর-মন নেচে নেচে উঠল অগ্নিশিখার মতো।

গান

হে মহাদুঃখ, হে রুদ্র, হে ভয়ংকর,

          ওহে শংকর, হে প্রলয়ংকর।

হোক জটানিঃসৃত অগ্নিভুজঙ্গম-

দংশনে জর্জর স্থাবর জঙ্গম,

ঘন ঘন ঝন-ঝন, ঝন-নন ঝন-নন

             পিণাক টংকরো॥

মা। কী রকম দেখলি তোর ভিক্ষুকে।

প্রকৃতি। দেখলুম, তাঁর অনিমেষ দৃষ্টি বহুদূরে তাকিয়ে, গোধূলি-আকাশের তারার মতো। ইচ্ছে হল, আপনার কাছ থেকে চলে যাই অনন্তযোজন দূরে।

মা। তুই আয়নার সামনে তখন নাচছিলি— তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন?

প্রকৃতি। ধিক্‌ ধিক্‌, কী লজ্জা! মনে হচ্ছিল, থেকে থেকে চোখ লাল হয়ে উঠছে, অভিশাপ দিতে যাচ্ছেন। আবার তখনি পা দিয়ে মাড়িয়ে দলে ফেলছেন রাগের অঙ্গারগুলো। শেষকালে দেখলেম, তাঁর রাগ ফিরল কাঁপতে কাঁপতে শেলের মতো নিজের দিকে, বিঁধল গিয়ে মর্মের মধ্যে।

মা। সমস্ত সহ্য করলি তুই?

প্রকৃতি। আশ্চর্য হয়ে গেলুম। আমি, এই আমি, এই তোমার মেয়ে, কোথাকার কে তার ঠিকানা নেই— তাঁর দুঃখ আর এর দুঃখ আজ এক। কোন্‌ সৃষ্টির যজ্ঞে এমন ঘটে— এতবড়ো কথা কেউ কোনোদিন ভাবতে পারত!

মা। এই উৎপাত শান্ত হবে কতদিনে।

প্রকৃতি। যতদিন-না আমার দুঃখ শান্ত হবে। ততদিন দুঃখ তাঁকে দেবই। আমি মুক্তি যদি না পাই তিনি মুক্তি পাবেন কী করে।