প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
নহে। পাপী অসাধুরা জগতের নীচের ক্লাসে পড়ে মাত্র, কিন্তু তাই বলিয়া তো তাহাদিগকে ইস্কুল হইতে তাড়াইয়া দিতে পারা যায় না। বাইবেলের অনন্ত নরক একটা সামাজিক জুজু বই তো আর কিছু নয়। পাপ নাকি একটা অভাব মাত্র, এই নিমিত্ত সে এত দুর্ব্বল যে তাহাকে পিষিয়া মারিয়া ফেলিবার জন্য একটা অনন্ত জাঁতার আবশ্যক করে না। সমস্ত জগৎ তাহার প্রতিকূলে তাহার সমস্ত শক্তি অহর্নিশি প্রয়োগ করিতেছে। পাপ পুণ্যে পরিণত হইতেছে, আত্মম্ভরিতা বিশ্বম্ভরিতার দিকে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছে।
নিতান্ত ঘৃণা করিয়া আর কাহাকেও একেবারে পর মনে করা শোভা পায় না। সকলেরই মধ্যে এত ঐক্য আছে। ঘুঁটে মহাশয় মস্ত লোক হইতে পারেন, তাই বলিয়া যে গোবরের সঙ্গে আদান প্রদান একেবারেই বন্ধ করিয়া দিবেন ইহা তাঁহার মত উন্নতিশীলের নিতান্ত অনুপযুক্ত কাজ।
পূর্বেই তো বলিয়াছি আমাদের অধিকাংশই অচেতন, একটুখানি সচেতন মাত্র। তবে আর জড়কে দেখিয়া নাসা কুঞ্চিত করা কেন? আমরা একটা প্রকাণ্ড জড়, তাহারই মধ্যে একরত্তি চেতনা বাস করিতেছে। আত্মায় ও জড়ে যে বাস্তবিক জাতিগত প্রভেদ আছে তাহা নহে। অবস্থাগত প্রভেদ মাত্র। আলোক ও অন্ধকারে এতই প্রভেদ যে মনে হয় উভয়ে বিরোধীপক্ষ। কিন্তু বিজ্ঞান বলে, আলোকের অপেক্ষাকৃত বিশ্রামই অন্ধকার এবং অন্ধকারের অপেক্ষাকৃত উদ্যমই আলোক। তেমনি আত্মার নিদ্রাই জড়ত্ব এবং জড়ের চেতনাই আত্মার ভাব। বিজ্ঞান বলে, সূর্যকিরণে অন্ধকার-রশ্মিই বিস্তর, আলোক-রশ্মি তাহার তুলনায় ঢের কম; একটুখানি আলোক অনেকটা অন্ধকারের মুখপাতের স্বরূপ। তেমনি আমাদের মনেও একটুখানি চৈতন্যের সহিত অনেকখানি অচেতনতা জড়িত রহিয়াছে। জগতেও তাহাই। জগৎ একটি প্রকাণ্ড গোলাকার কুঁড়ি, তাহার মুখের কাছটুকুতে একটুখানি চেতনা দেখা দিয়াছে। সেই মুখটুকু যদি উদ্ধত হইয়া বলে আমি মস্তলোক, জগৎ অতি নীচ, উহার সংসর্গে থাকিব না, আমি আলাদা হইয়া যাইব, তবে সে কেমনতর শোনায়?
ধর্মকে আশ্রয় করিলে মৃত্যুভয় থাকে না। এখানে মৃত্যু অর্থে ধ্বংসও নহে, মৃত্যু অর্থে অবস্থাপরিবর্ত্তনও নহে, মৃত্যু অর্থে জড়তা। অচেতনতাই অধর্ম। ধর্মকে যতই আশ্রয় করিতে থাকিব, ততই চেতনা লাভ করিতে থাকিব, ততই অনুভব করিতে থাকিব, যে মহাচৈতন্যে সমস্ত চরাচর অনুপ্রাণিত হইয়াছে, আমার মধ্য দিয়া এবং আমাকে প্লাবিত করিয়া সেই চৈতন্যের স্রোত প্রবাহিত হইতেছে। যথার্থ জগৎকে জ্ঞানের দ্বারা জানিবার কোন সম্ভাবনা নাই, চৈতন্য দ্বারা জানিতে হইবে।