অনুবাদ-চর্চা

৫৩

উত্তর মেরুপ্রদেশে প্রথম আগমনে যে ছবি মনে মুদ্িরত হয় তাহা স্মৃতিপথে অনেক কাল লাগিয়া থাকে। কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া হয়ত তুমি সমুদ্রের মাঝখানে এক দিক হইতে অন্য দিকে ভাসিয়া বেড়াইতেছ; ক্রমশ জাহাজ শান্ততর জলরাশির মধ্যে আসিয়া পৌঁছিল। কিছু দিন ধরিয়া যে কুয়াসা জাহাজের কয়েক গজ মাত্র দূরের সমস্ত দৃশ্য অস্পষ্ট করিয়া রাখিয়াছিল তাহা পরিষ্কার হইয়া গেল, ডাঙার উপরকার ঝাপসাভাব (land haze) দেখা গেল, সূর্য্য সীসকবর্ণ আকাশ হইতে বাহির হইয়া আসিল।

৫৪

একখণ্ড বরফ জাহাজের পার্শ্বদেশ ঘর্ষণ করিল এবং এক মাইল দূরে সমুদ্রের মধ্যে দোলায়িত একটি সাদা জিনিষের প্রতি তোমার মনোযোগ আকৃষ্ট হইল। ইহাই প্রথম ভাসমান তুষারপর্ব্বত। তুমি আরো নিকটে আসিলে তুষারগিরি-সকল এত বহুসংখ্যক হইল যে, অসুখজনক হইয়া উঠিল; শীতলজলতল হইতে কৌতূহলী সীলগুলি তাহাদের মাথা উপরে তুলিতেছে। একটা সাদা তিমি বা ছোটো একঝাঁক নর্‌হ্বল তিমি গুরুশ্বাস ফেলিয়া জাহাজের চারি দিকে বেড়াইতেছে।

৫৫

S–তাহার পীড়িত ভ্রাতা চার্ল্‌সের সেবা করিতেছিল, ঐ ভাইটি পরে মারা গিয়াছে, ঐ ঘটনা আমাকে অত্যন্তই ব্যথিত করিয়াছে। S–অপেক্ষা চার্লি ছোটো ছিল, সে অতি মনোহরস্বভাবের যুবক ছিল। সে আমার পিতার নিকট কাজ করিত, দুই বৎসর ধরিয়াই কাজ করিয়াছে। যতগুলিকে আমি জানি তাহাদের মধ্যে সেই’ই অল্পবয়স্ক গ্রাম্য কৃষিমজুরের সর্ব্বোৎকৃষ্ট নমুনা। তুমি তাহাকে দেখিলে ভালোবাসিতে। সে তোমারই একটি কবিতার মতো ছিল। বিপুল শারীরিক বল, প্রফুল্লতা ও সন্তোষ, সর্ব্বজনীন মঙ্গলেচ্ছা এবং নিঃশব্দ পুরুষোচিত ব্যবহারে ঐ যুবকের তুলনা মেলা দুষ্কর ছিল। একটা বৃদ্ধ চিকিৎসক তাহাকে হত্যা করিল। তাহার টাইফয়েড জ্বর হইয়াছিল, কিন্তু ঐ বৃদ্ধ নির্ব্বোধ দুইবার তাহার রক্তমোক্ষণ করিল।

৫৬

জ্বরাবসান অতিক্রম করিয়াও বাঁচিয়া ছিল, কিন্তু আপদ কাটাইয়া উঠিবার মতো শক্তি তাহার ছিল না। সকালবেলা S–যখন দাঁড়াইয়া ছিল চার্লি তখন দুই বাহুদ্বারা S–এর কণ্ঠালিঙ্গন করিয়া, তাহার মুখ টানিয়া নামাইয়া চুম্বন করিল। S–বলে সে তখনই জানিতে পারিল যে, শেষাবস্থা নিকটে। S–শেষ পর্য্যন্ত দিবারাত্রি তাহার সঙ্গে লাগিয়া ছিল। সে তোমার ধরণের মানুষ ছিল বলিয়া আমি এত করিয়া তোমাকে তাহার কথা লিখিলাম। তাহার সহিত তোমার যদি পরিচয় হইত, আমি সুখী হইতাম। তাহার মধ্যে শিশুর মাধুর্য্য এবং তরুণ বাইকিঙের সাহস শক্তি এবং সদাতৎপরভাব ছিল। তাহার পিতামাতা দরিদ্র। অধিক কাজের তাড়া পড়িলে তাহার মাতাও স্বামীর সহিত ক্ষেত্রে কাজ করেন।

৫৭

সেদিন অপরাহ্নে ভারী গরম ছিল; আর জাহাজ তখন কেপ্‌টাউনের প্রায় ১৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। ছায়াতেই উত্তাপ তখন ১০৫ ডিগ্রী, আকাশ তাম্রবর্ণ, সাগর ফুটন্ত তেলের মতো। হঠাৎ আমি ডেকের উপর হইতে একটা বিকট চীৎকার শুনিতে পাইলাম এবং দেখিলাম আতঙ্কগ্রস্ত কাফ্রিরা ছুটিয়া পালাইবার চেষ্টা করিতেছে। জাহাজের তটান্তিক ভাগের উপর দিয়া তাকাইয়া আমি এমন একটি জীবকে দেখিতে পাইলাম যাহার চেয়ে বিকটমূর্ত্তি জলচর বা স্থলচর প্রাণী কল্পনা করার সম্ভাবনামাত্র নাই। যদি আমি শান্তভাবে এমন কথা বলি যে, ঐ যে জীবটিকে দেখিয়াই প্রাচীনকালের বর্ণিত সমুদ্রের সর্প বলিয়া বুঝিয়াছিলাম তাহার মাথাটা একটা বড়ো আয়তনের পিপার মতো, তবে মনে করিয়ো না আমি অত্যুক্তি করিতেছি।