মন্ত্রি-অভিষেক

তদ্ভিন্ন তাঁহারা কয় জন দেশীয় উপযুক্ত লোককে রীতিমত জানেন? তাঁহাদের নির্ব্বাচনক্ষেত্রের পরিধি কতই সঙ্কীর্ণ! উপাধিবান রাজা উপরাজার সহিতই তাঁহাদের কিয়ৎপরিমাণ মৌখিক আলাপ আছে মাত্র। মন্ত্রিসভায় আসন পাওয়া যাঁহারা কেবলমাত্র সম্মান বলিয়া জ্ঞান করেন, জীবনের গুরুতর কর্ত্তব্য বলিয়া জ্ঞান করেন না, তাঁহারাই অধিকাংশ সময়ে সেখানে স্থান পাইয়া থাকেন।

অবশ্য, সময়ে সময়ে ইহার ব্যতিক্রমও ঘটিয়াছে। অনেক যোগ্য ব্যক্তিও স্থান পাইয়াছেন সন্দেহ নাই। তাঁহাদের মধ্যে কাহারও কাহারও সহিত বর্তমান বক্তার পরম গৌরবের আত্মীয়তাসম্পর্ক আছে। কিন্তু সে-সকল যোগ্য ব্যক্তি সাধারণের অপরিচিত নহেন। সাধারণের দ্বারা তাঁহাদের নির্ব্বাচিত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল।

আমার জিজ্ঞাস্য কেবল এই যে, আমাদের অপেক্ষা গবর্মেন্টের অর্থাৎ দুই-চারি জন ইংরাজের এ বিষয়ে অধিক অভিজ্ঞতা কোথায়? আমাদের শিক্ষিতসাধারণে যাঁহাদিগকে বড়লোক বলিয়া জানেন তাঁহাদের অবশ্য কিছু না কিছু যোগ্যতা আছেই। কিন্তু গবর্মেন্টের যাঁহাদিগকে বড়লোক বলিয়া জানেন, তাঁহাদের বিপুল ঐশ্বর্য্য, বৃহৎ শিরোপা বা অতিবিনীত সেলামের ক্ষমতা থাকিতে পারে, কিন্তু যথার্থ যোগ্যতা না থাকিতেও পারে।

আমরা যতদূর দেখিতে পাই তাহাতে আমাদের বিশ্বাস, মন্ত্রিসভায় দেশীয় মন্ত্রী নিয়োগ গবর্মেন্টের তেমন অত্যাবশ্যক মনে করেন না, সুতরাং নিব্বার্চনের সময় যথেষ্ট সাবধান ও বিবেচনার সহিত কাজ করা তাঁহারা অনেকটা বাহুল্য বোধ করিতে পারেন। কিন্তু আমাদের ভাব ঠিক তাহার বিপরীত। গবর্মেন্টের বাস্তবিক সুপরামর্শ দিয়া দেশের হিতসাধন করিতে হইবে এবং স্বজাতির যোগ্যতা প্রমাণ করিয়া গৌরব লাভ করিব, এই আমাদের উদ্দেশ্য, কেবলমাত্র সভাগৃহের শোভাসম্পাদনে আমাদের কোন ফল নাই, স্বার্থ নাই। সুতরাং নির্ব্বাচনের সময় আমাদিগকে সবিশেষ বিবেচনার সহিত কাজ করিতে হইবে।

পুনশ্চ,গবর্ণমেন্ট যাঁহাদিগকে নিযুক্ত করেন তাঁহারা গবর্মেন্টের অনুগ্রহ-আশ্রয়ে নির্ভয়ে থাকিতে পারেন, আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির সে আশা নাই, সুতরাং খুব মজবুৎ দেখিয়াই লোক বাছিতে হইবে। অতএব আমাদের হাতে যোগ্য লোক বাছাই হইবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

অর্থাৎ, গ্রাম্য ভাষায় যাহাকে “গরজ” বলে তাহার দ্বারা সংসারের অধিকাংশ কাজ হইয়া থাকে। মন্ত্রিসভায় দেশীয় লোক নির্ব্বাচন করিতে গবর্ণমেন্টের কোন গরজ দেখা যাইতেছে না। অর্দ্ধ অনিচ্ছার সহিত তাঁহারা একটা আপোষে মীমাংসা করিতে চাহেন। লর্ড্‌ ক্রস বলেন যদি ভারতশাসনকর্ত্তারা ইচ্ছা করেন ত নিজে গুটিকতক দেশীয় লোক নির্ব্বাচন করিয়া মন্ত্রীসংখ্যা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি করিতে পারেন। আমাদের ভারতরাজকর্মচারীগণও এ বিষয়ে যে বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করিতেছেন তাহা বলিতে পারি না।

অতএব যখন দেশীয় মন্ত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি করিতে গবর্ণমেন্টের কিছুমাত্র গরজ নাই, অর্থাৎ তাঁহাদের মতে দুই-চারিটা দেশী লোককে ডাকিলেও চলে, না ডাকিলে হয়ত আরো ভালো চলে, তখন তাঁহাদের হাতে নির্ব্বাচনের ভার কোন্‌ সাহসে দিই! গরজ আমাদেরই। অতএব আমরাই যথার্থ নির্ব্বাচনের অধিকারী।

এমন দুরাশাও আমরা করিতেছি না যে, আমাদের প্রতিনিধিদের হস্তে রাজক্ষমতা থাকিবে। তাঁহারা কেবল নিবেদন করিবেন মাত্র; বিচারের ভার, কার্য্যের ভার তোমাদের। আমরা কেবল জানাইতে চাহি ও জানিতে চাহি। তোমরা আমাদের উপর আইন খাটাইবে। আমরা আমাদের গায়ের মাপ দিতে চাহি। দেখাইতে চাহি কোথায় কষাকষি করিলে আমাদের নিঃশ্বাস রোধ হইয়া আসে, এবং কোথায় ঢিলা হইলে আমাদের অনাবশ্যক ব্যয়বাহুল্য ও আরামের ব্যাঘাত হয়।

অতএব আমাদেরই লোক যদি না পাঠাইলাম তবে আমাদের আবশ্যক কে জানাইবে? তোমরা যাহাকে নির্ব্বাচন করিয়া সন্মানিত কর সে স্বাভাবতই কিয়ৎ পরিমাণে তোমাদের অঙ্গভঙ্গীর অনুকরণ করে ও তোমাদেরই ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করে মাত্র। তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কথা জানাইতে সহজে তাহার প্রবৃত্তি হইতেই পারে না।