সত্য
রণসংগীত! নিদ্রিত বাঙালি তবে কি সত্যসত্যই সত্যের মর্মভেদী আহ্বান শুনিয়াছে! এ কথা বিশ্বাস হয় না। যদি বা আমরা সংশয়গ্রস্ত ভীত দুর্বলচিত্তে রণক্ষেত্রে গিয়া দাঁড়াই যুদ্ধ করিতে পারিব না, বিঘ্নবিপদ দেখিলে মূর্ছিত হইয়া পড়িব, ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিব। যে বাঙালি স্বজাতিকে স্পষ্ট উপদেশ দেয় যে, ছলনা আশ্রয় করিয়া গোপন অখাদ্যখাদন প্রভৃতি সমাজবিরুদ্ধ কাজ করিলে কোনো দোষ নাই, প্রকাশ্যে করিলেই তাহা দূষণীয়, যে বাঙালি এই উপদেশ অসংকোচে শুনিতে পারে, এবং যে বাঙালি কাজেও এইরূপ অনুষ্ঠান করিয়া থাকে, সে বাঙালি কখনো ধর্মযুদ্ধের আহ্বানে উত্থান করিবে না। তাহারা দলাদলি গালাগালি ঝগড়াঝাঁটি তর্কবিতর্ক এ-সকল কার্য পরম উৎসাহের সহিত সম্পন্ন করিবে, কপট কৃত্রিম মিথ্যাকথা সকল অত্যন্ত সহজে উচ্চারণ করিবে--তদূর্ধ্বে আর কিছুই নয়। এ কথা কি কাহাকেও বলিতে হইবে যে, বাঙালিদের একমাত্র বিশ্বাস সেয়ানামির উপরে! প্রবাদ আছে 'হুজ্জুতে বাঙালি'। বাঙালি মনে করে যথেষ্ট পরিমাণে পরিশ্রম না করিয়াও গোলেমালে কাজ সারিয়া লওয়া যায়, বীজ রোপণ না করিয়াও কৌশলে ফললাভ করা যায়, তেমন ফন্দি করিতে পারিলে মিথ্যার দ্বারাও সত্যের কাজ আদায় করা যাইতে পারে। এইজন্য বাঙালি কাগজ লইয়া দাম দেয় না, দাম লইয়া কাগজ দেয় না, কাজ না করিয়াও দেশহিতৈষী হইয়া উঠে, বিশ্বাস করে না তবু লেখে ও এই উপায়ে মিথ্যাকথা বলিয়া অর্থ সঞ্চয় করে। বাঙালির জীবনটা কেবল গোঁজামিলন। যেখানে সহজে ফাঁকি চলে সেখানে বাঙালি ফাঁকি দিবেই। এইরূপে পৃথিবীকে বঞ্চনা করিতে চেষ্টা করিয়া বাঙালি প্রতিদিন বঞ্চিত হইতেছে।

কেবলই কি বাঙালিকে মিষ্ট মিথ্যাকথা-সকল বলিতে হইবে? কেবলই বলিতে হইবে, আমরা অতি মহৎ জাতি, আমরা আর্যশ্রেষ্ঠ, ইংরাজেরা অতি হীন, উহারা ম্লেচ্ছ যবন। আমরা সকল বিষয়েই উপযুক্ত, কেবল ইংরেজেরাই আমাদিগকে ফাঁকি দিতেছে। বলিতে হইবে ইংরেজসমাজ স্বেচ্ছাচারিতার রসাতলে গমন করিয়াছে, আর আমাদের আর্যসমাজ উন্নতির এমনি চূড়ান্ত সীমায় উঠিয়াছিল যে তদূর্ধ্বে আর এক ইঞ্চি উঠিবার স্থান ছিল না, তাহাতে আর এক-তিল পরিবর্তন চলিতে পারে না। এই উপায়ে ক্ষুদ্রের অহংকার ক্রমিক পরিতৃপ্ত করিয়া কি 'পপুলার' হইতেই হইবে? আমরা যে কত ক্ষুদ্র তাহা আমরা জানি না, সেইটাই আমাদের জানা আবশ্যক। আমরা যে কত মস্ত লোক, তাহা ক্রমাগতই চতুর্দিক হইতে শুনা যাইতেছে। কর্ণ জুড়াইয়া নিদ্রাকর্ষণ হইতেছে, সুখস্বপ্নে আপন ক্ষুদ্রত্বকে অত্যন্ত বৃহৎ দেখাইতেছে। এখন মিথ্যাকথা সব দূর করো, একবার সত্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করো। অন্য জাতির কেন উন্নতি হইতেছে এবং আর্যশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতিরই বা কেন অবনতি হইতেছে, তাহা ভালো করিয়া দেখো। আমাদের মজ্জার মধ্যে কী হীনত্ব আছে, আমাদের শাস্ত্রের কোন্‌ মর্মস্থলে ঘুণ ধরিয়াছে যাহাতে আমাদের এমন দুর্দশা হইল, তাহা ভালো করিয়া দেখো। ইংরেজসমাজের মধ্যে এমন কী গুণ আছে,যাহার ফলে এমন উন্নত সাহিত্য, এমন-সকল বীরপুরুষ, স্বদেশপ্রেমী মানবহিতৈষী, জ্ঞান ও প্রেমের জন্য আত্মবিসর্জন-তৎপর নরনারী ইংরেজসমাজে জন্মলাভ করিতেছে, আর আমাদের সমাজের মধ্যেই বা এমন কী গুরুতর দোষ আছে যাহার ফলে এমন-সকল অলস, ক্ষুদ্র, স্বার্থপর, পল্লবগ্রাহী, মিথ্যাঅহংকারপরায়ণ সন্তান-সকল জন্মগ্রহণ করিতেছে, সত্যজিজ্ঞাসু হইয়া অপক্ষপাতিতার সহিত তাহা পর্যালোচনা করিয়া দেখো। ইহাতে উপকার হইতে পারে। আর, আমরাই ভালো এবং ইংরেজেরাই মন্দ ইহা ক্রমাগত বলিলে ও ক্রমাগত শুনিলে ক্রমাগতই মিথ্যাপ্রচার ছাড়া আর কোনো ফললাভ হইবে না।

সত্যকথা বলা ভালো আজ আমার এই কথা সকলের পুরাতন ঠেকিতেছে। সত্য চিরদিনই নূতন, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে, দুর্বলতাবশত পুরাতন হইয়া যায়। সত্যকে যতক্ষণ সত্য বলিয়া অনুভব করিতে থাকি, ততক্ষণ তাহা নূতন থাকে, কিন্তু যখন মনের অসাড়তাবশত আমরা সত্যকে কেবলমাত্র মানিয়া লই অথচ মনের মধ্যে অনুভব করিতে পারি না, তখন তাহার অর্ধেক সত্য চলিয়া যায়, সে প্রায় মিথ্যা হইয়া উঠে। যে শব্দ আমরা ক্রমাগত শুনি, অভ্যাসবশত তাহা আর শুনিতে পাই না, এই কারণে পুরাতন সত্য সকলে বলিতে পারে না। মহাপুরুষেরাই পুরাতন সত্য বলিতে পারেন-- বুদ্ধ, খৃস্ট, চৈতন্যেরাই পুরাতন সত্য বলিতে পারেন। সত্য তাঁহাদের কাছে চিরদিন নূতন থাকে, কারণ সত্য তাঁহাদের যথার্থ প্রিয়ধন। আমরা যাহাকে ভালোবাসি সে কি আমাদের কাছে