পরিশিষ্ট

এ কথা সত্য হইলেও ইহাতে আমরা কোনো দোষ দেখি না।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এবং দুঃখের বিষয় এই যে, তাঁহারাই ভারতবর্ষীয় কন্‌গ্রেস প্রভৃতি সভামন্ডলীর মধ্যে পৈতৃক ধনে ধনী এবং বৃহৎ উপাধিতে ভূষিত লোকের সন্ধান করেন এবং না পাইলে উপেক্ষা-প্রকাশের চেষ্টা করিয়া থাকেন।

কন্‌‍গ্রেসেই কি আর ম্যুনিসিপ্যাল পৌরসভাতেই কি, সুযোগ্য বাঙালি ভদ্রলোকের অভাব নাই। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীনাথ মিত্র, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, নলিনবিহারী সরকার, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, ইঁহারা কোনো কালে লেফ্‌টেনান্ট্‌ গর্বনর হইতে পারিবেন না সন্দেহ নাই; কিন্তু না পারিবার কারন এই যে, ইংরাজ-আমলে ভারতশাসনের উচ্চতর অধিকার-সকল হইতে আমরা বঞ্চিত।

আমাদিগকে যেটুকু অধিকার দেওয়া হাইয়াছে তাহা যদি সহ্য না হয়, যদি সেটা ফিরাইয়া লইবার মতলব থাকে, তবে লও— কিন্তু গালিমন্দ কেন।

ঈসপের কথামালায় নেকড়ে বাঘ যখন মেষশাবকটিকে ভক্ষণ করিতে ইচ্ছা করে তখন বলে, তুমি আমার ঝর্নার জল নষ্ট করিয়াছ। মেষ বলে, প্রভু, তুমি উপরের জল খাও, আমি নীচের জল খাইতেছি, তোমার জল আমি নষ্ট করিলাম কেমন করিয়া। বাঘ বলে, তুই না করিস তোর বাপ করিয়াছিল; তাহার পর এক চপেটাঘাত।

আমরা মেষশাবকেরও অধম। প্রভেদ এই যে, বাঘের পক্ষে যেটা ছুতা ছিল ম্যাকেঞ্জি-সাহেবের পক্ষে সেইটেই আসল কথা। এতদিন সেটা চাপিয়া গিয়াছিলেন; খানার পরে পরিতৃপ্তমনে বন্ধুসভায় সেটা ব্যক্ত করিয়াছেন। ঐশ্বর্য-ঝর্নায় ম্যাকেঞ্জি-সাহেবদের অনেক নীচের জলে আমরা তৃষ্ণা নিবারণ করিয়া থাকি। কিন্তু সেও অসহ্য। ম্যাকেঞ্জি-সাহেব তাঁহার ভোজাবসানের বক্তৃতায় বলিয়াছেন, কলিকাতার কর্তৃত্বভার অসাবধানে আমাদের হাত হইতে অনেকটা খসিয়া পড়িয়াছে। হায়! এটুকুর প্রতিও লোভ! যাহা স্বহস্তে দান করিয়াছ তাহার প্রতিও লোলুপ দৃষ্টি! বিস্তর নীচে আছি, এবং অতন্ত অল্প জল পাই; আমাদের দেশী স্পর্শে তোমাদের উচ্চ শিখরের জল তো আমরা ঘোলা করি নাই।

নেকড়ে বাঘ মনে মনে বলেন, উচ্চ হোক নীচ হোক, প্রভুত্বের স্বাদমাত্রই তোমাদিগকে দিতে চাহি না। তাহার পর মুখে বলেন, ‘তোমরা অযোগ্য, ইন্ডিয়া-ক্লাবে বৈঠক কর, তোমরা স্বদেশের প্রতিনিধি নও।’

বেসরকারি ইংরাজ-সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের বাগ্‌যুদ্ধ চলে। আমরা অনেক সময় রাগের মুখে পরস্পরের প্রতি করুণবাক্য প্রয়োগ করি না। কিন্তু যাঁহারা ভারতশাসনকার্যে রাজস্থানীয় এতদিন তাঁহারা প্রজাসাধারণকে প্রকাশ্যে রূঢ়ভাষায় অপমান করেন নাই।

আমাদের প্রতি তাঁহাদের যে অত্যন্ত শ্রদ্ধা আছে তাহা না হইতে পারে, প্রচুর স্নেহ আছে এমন অভিমানও হয়তো না করিতে পারি, কিন্তু তাঁহারা বাক্‌সংযম করিয়া গেছেন। তাহার একটা কারণ, তাঁহারা যে উচ্চ পদের উন্নত শিখরে থাকেন সেখান হইতে একটি ছোটো কথা বর্ষণ করিলেও নীচের লোকের মাথার পক্ষে তাহা গুরুতর হইয়া উঠে— এরুপ অসমকক্ষ আক্রমণ বীরোচিত নহে। ইংরাজি ভাষায় যাহাকে cowardliness অর্থাৎ কাপুরুষতা বলে ইহাও তাহাই। আর-একটা কারণ এই যে, কথার কলহ তাঁহার পক্ষে অনাবশ্যক এবং অযোগ্য; কারণ, তাঁহার হাতে ক্ষমতা আছে। শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা। সে ক্ষমা কাজের ক্ষমা না হইলেও, অন্তত বাক্যের ক্ষমা হওয়া উচিত।

রাজনীতির হিসাবেও বাক্‌সংযমের সার্থকতা আছে। রাজকার্য সকল সময়ে প্রজার অনুকূলে যায় না। অতএব মাঝে মাঝে যখন কঠিন আইন বা অপ্রিয় করবৃদ্ধি প্রজার উপরে জারি করিতে হইবে তখন দুর্বাক্য-দ্বারা সেটাকে আরো তিক্ত করিয়া তুলিলে রাজাপ্রজার মধ্যে একটা সংঘর্ষ অনাহূত বাড়াইয়া তোলা হয়।

স্বাধীন ইংলন্ডে পার্লামেন্টে ভিন্ন ভিন্ন দলের মধ্যে বিবাদ-বচসা হইয়া থাকে, কেহ কাহাকেও ছাড়িয়া কথা কহে না। কিন্তু