প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
|
![]() |
অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান জয়তি সমুলস্তু বিনশ্যতি॥
এই ধর্মবাণী সকল দেশের সকল কালের চিরন্তন সত্য,ন্যাশনালত্বের মূলমন্ত্র ইহার নিকট ক্ষুদ্র ও ক্ষণিক। নেশন শব্দের অর্থ যখন লোকে ভুলিয়া যাইবে তখনো এ সত্য অম্লান রহিবে এবং ঋষি-উচ্চারিত এই ব্যক্য স্পর্ধামদমত্ত মানবসমাজের ঊর্ধ্বে বজ্রমন্ত্রে আপন অনুশাসন প্রচার করিতে থাকিবে।
এলাহাবাদে সোমেশ্বর দাসের কারাবরোধের কথা সকলেই জানেন। কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি অবিচার মাসিকপত্রের আলোচ্য বিষয় নহে। কিন্তু বর্তমান ব্যাপারটি ব্যক্তিবিশেষকে অবলম্বন করিয়া সমস্ত ভারতবাসীর প্রতি লক্ষনিবেশ করিয়াছে। সেইজন্য এ সম্বন্ধে সংক্ষেপে গুটিকয়েক কথা বলিতে হইতেছে।
পায়োনিয়র লিখিতেছেন,ভারতবর্ষে নানাজাতীয় লোক একত্রে বাস করে। ইহাদের মধ্যে শান্তিরক্ষা করিয়া চলা ব্রিটিশ গবর্মেণ্টের একটি দুরূহ কর্তব্য। সুতরাং যে ঘটনায় ভিন্নজাতির মধ্যে সংঘর্ষ বাধিবার সম্ভাবনা হয়,সেটার প্রতি বিশেষ কঠিন বিধানের প্রয়োজন ঘটে। সে হিসাবে সোমেশ্বর দাসের কারাদন্ডকে গুরুদণ্ড বলা যায় না।
সুযোগ্য ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘নিয়ু ইন্ডিয়া’ পত্রে পায়োনিয়রের এই-সকল যুক্তির অযথার্থতা ভালোরূপেই দেখানো হইয়াছে। ইংরেজের যে-সকল ব্যবহারে ভারতবাসীর মনে বিক্ষোভ উপস্থিত হয় ইংরেজ বিচারক তাহাকে যে কত লঘুভাবে দেখিয়া থাকে তাহার শত শত প্রমাণ প্রত্যহ দেখিতে পাই। এই সেদিন একজন সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণকে কোনো ইংরেজ পাদুকা বহন করাইয়াছিল— দেশের উচ্চতম আদালতে পর্যন্ত স্থির হইয়া গেছে,ব্যাপারটা অত্যন্ত ‘তুচ্ছ।১ তুচ্ছ হইতে পারে, কিন্তু পায়োনিয়রের যুক্তি অনুসারে তুচ্ছ নহে। ভদ্র ব্রাহ্মণের এরুপ নিষ্ঠুর অপমান ভারতবাসীর কাছে অত্যন্ত গুরুতর।
তাহা হইলে কথাটা কী দাঁড়াইতেছে, বুঝিয়া দেখা যাক। যে-সকল জাতি law-abiding, অর্থাৎ বিনা বিদ্রোহে আইন মানিয়া চলে, তাহাদেরই অপমান আদালতের কাছে তুচ্ছ। যাহারা কিছুতেই শান্তিভঙ্গ করিবে না, তাহাদিগকে অন্যায় আঘাত করাও অল্প অপরাধ। আর যাহারা অসহিষ্ণু, যাহার নিজের আইন নিজে চালাইয়া বসে, সংগত কারণেও তাহাদের গায়ে হাত দিবার উপক্রমমাত্র অপরাধ।
ব্রিটিশরাজ্যে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খাওয়াইবার উপায় বাঘকে দমন করিয়া নহে, গোরুটারই শিং ভাঙিয়া।
কিন্তু পায়োনিয়রের এ কথাটা লইয়া রাগ করিতে পারি না। পায়োনিয়র বন্ধুভাবে আমাদিগকে একটা শিক্ষা দিয়াছেন। বস্তুতই বারুদে আগুন দেওয়া যতবড়ো অপরাধ, ভিজা তুলায় আগুন দেওয়া ততবড়ো অপরাধ নহে। যাহারা চিরসহিষ্ণু তাহাদের অপমানকে অপরাধ বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে না। অতএব আঘাত অপমান সম্বন্ধে আমরা আইন বাঁচাইব, কিন্তু আইন আমাদিগকে বাঁচাইবে না। Mild Hindu দের প্রতি পায়োনিয়রের ইহাই নিগূঢ় বক্তব্য।
১ দ্রষ্ট্রব্যঃ ‘ব্রাহ্মণ’ প্রবন্ধ, ভারতবর্ষ, রবীন্দ্র-রচনাবলী ৪ (সূলভ সংস্করণ ২)