পরিশিষ্ট
সেজন্য ইংরাজ যদি নিজেকে আমাদের চেয়ে বেশি বাহাদুর মনে করেন, তো করুন, কিন্তু আমরা কেন ইংরাজের তরফ হইতে স্বজাতিকে বিচার করি? যে ভাবে আমরা চিরকাল মনুষ্যত্বচর্চা করিয়া আসিতেছি ইংরাজের সহিত সংঘাতে তাহাতে আমাদের অসুবিধা ও অপমান ঘটিতেছে। তা হইতে পারে, কিন্তু তাই বলিয়া মনুষ্যত্বে আমরা খাটো এ কথা আমরা তো স্বীকার করিতে পারিব না। মানুষ হইতে গেলে দাঁত-নখের খর্বতা ঘটিয়া থাকে, তাই বলিয়া কি লজ্জা পাইব! রোমের সম্রাট নগ্ন-নিরস্ত্র খৃস্টানদিগকে ক্রীড়াঙ্গনে পশু দিয়া হত্যা করিয়াছিলেন— ধর্মরাজ যদি তাহার বিচার করিয়া থাকেন, তিনি কি রোমরাজের পৌরুষকেই সম্মান দিয়াছেন? আমরা যদি যথার্থভাবে সহ্য করিতে পারি, আমরা যদি সহিষ্ণুতার জন্য নিজেকে হেয় বলিয়া অন্যায় ভ্রম না করি, তবে ধর্ম আমাদের বিচার গ্রহণ করিবেন। কিন্তু রচনানীতির খাতিরে বা যে কারণেই হউক, এ কথা আমরা যেন অনায়াসেই উচ্চারণ করিয়া না বসি যে, আমরা হইলেও ঠিক এইরূপ করিতাম বা ইহাদিগকেও ছাড়াইয়া যাইতাম। না, আমরা হইলে এরূপ করিতাম না। ইহাই আমাদের সান্ত্বনা। আমাদের সমাজের, আমাদের ধর্মের যে আদর্শ, আমাদের শাস্ত্রের যে অনুশাসন, আমাদের স্বভাবের যে গতি, তাহাতে অক্ষমকে আমরা আত্মীয়শ্রেণীভুক্ত করিয়া লইতাম। আমরা ভিক্ষুককে, দুর্বলকে, প্রাচীনকে কখনো অবজ্ঞা করি নাই।

রাজা এবং রাজকুটুম্ব ঠিক এক নহে, কিন্তু তবু রাজসম্পর্কের গন্ধ থাকিলেও কুটুম্বদের উৎপাত সহ্য করিতেই হয়। মৃচ্ছকটিকের রাজশ্যালকের কথা পাঠকগণ স্মরণ করিবেন। প্রভেদ এই যে, উক্ত কুটুম্ববর্গের সংখ্যা এখন অনেক বাড়িয়া গেছে।

মৃচ্ছকটিকের সেই রাজশ্যালকটি যতই উপদ্রব করুক-না কেন, প্রজাবর্গের কাছে তাহার সম্মান ছিল না— সকলেই তাহাকে উৎপাত বলিয়াও জানিত, অথচ তাহাকে মনে-মুখে পরিহাস-বিদ্রূপ করিতে ছাড়িত না। এখনকার রাজশ্যালকগণের নিকট হইতে ঠিক সে পরিমান হাস্যরস আদায় করা কঠিন, কিন্তু তাঁহাদের ব্যবহারে তাঁহারা প্রত্যহ আমাদের কাছে যে পরিমাণে সম্ভ্রম হারাইতেছেন তাহা যেন আমাদের মাথা তুলিবার সহায়তা করে।


ঘুষাঘুষি

গত বৈশাখ মাসের বঙ্গদর্শনে ‘রাজকুটুম্ব’-শীর্ষক প্রবন্ধে নিয়ু ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত কোনো রচনার সমালোচনা করা হইয়াছিল। নিয়ু ইন্ডিয়ার সম্পাদকমহাশয় আমাদিগকে ভুল বুঝিয়াছেন। তিনি স্থির করিয়াছেন, এক গালে চড় খাইয়া অন্য গাল ফিরাইয়া দেওয়া যদি-বা আমাদের মত না হয়, অন্তত অশ্রুজলপ্রবাহে আহতগণ্ডের আঘাত-বেদনার উপশমচেষ্টাই আমাদের মতে শ্রেয়।

ইংরাজের ঘুষিঘাষা খাইয়া নাকিসুরে নালিশ করা এ দেশে কিছুকাল পূর্বে অত্যন্ত অধিকমাত্রায় প্রচলিত ছিল। একটা কাককে ঢেলা মারিলে পৃথিবীসুদ্ধ কাক যেমন চীৎকার করিয়া মরে, দেশী লোকের মার খাইবার খবরে আমাদের খবরের কাগজগুলি তেমনি করিয়া অবিশ্রাম বিলাপপরিতাপে আকাশ বিদীর্ণ করিত।

আমরাই সর্বপ্রথমে ‘সাধনা’ পত্রিকায় এই নাকিকান্নার বিরুদ্ধে বারংবার আপত্তি উত্থাপন করিয়াছি— এবং কথঞ্চিৎ ফললাভ করিয়াছি তাহাও দেখা যাইতেছে। আজ হঠাৎ আত্মপ্রতিবাদের যে কোনো কারণ ঘটিয়াছে তাহা বোধ হয় না।

ছবিতে যেমন চৌকা জিনিসের চারিটা পাশই একসঙ্গে দেখানো যায় না, তেমনি প্রবন্ধেও একসঙ্গে একটা বিষয়ের একটি, বড়োজোর দুইটি দিক দেখানো চলে। ‘রাজকুটুম্ব’ প্রবন্ধেও আমাদের বক্তব্যবিষয় খুব ফলাও নহে। নিয়ু ইন্ডিয়ার সম্পাদকমহাশয় যখন ভুল বুঝিয়াছেন, তখন সম্ভবত আমাদের রচনায় কোনো ত্রুটি থাকিতে পারে। এবারে ছোটো করিয়া এবং স্পষ্ট করিয়া বলিবার চেষ্ট করিব।

ভারতবর্ষে যে মারে এবং যে মার খায়, এই দুই পক্ষের অবস্থা লইয়া আমরা কিঞ্চিৎ তত্ত্বালোচনা করিয়াছিলাম মাত্র। আমরা