প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
ষখন দেখি– পারে, তখন মনের মধ্যে কেবল অপমানের ব্যথা নহে, একটা আতঙ্ক জাগিয়া উঠে। আমাদের অবস্থা যে কিরূপ নিঃসহ উপায়বিহীন, কিরূপ সম্পূর্ণ পরের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া আছে, আমাদের নিজের শক্তি যে এতটুকুও অবশিষ্ট নাই যে রাষ্ট্রনীতির রথটা আমাদের প্রবল অনিচ্ছাকেও একটি ক্ষুদ্র বাধা জ্ঞান করিয়াও অল্পমাত্র বাঁকিয়া চলিবে, ইহা যখন বুঝি তখন নিরুপায়ের মনেও উপায়-চিন্তার জন্য একটা ক্ষোভ জন্মে।
কিন্তু আমাদের প্রতি রাষ্ট্রনীতির এতদুর উপেক্ষার কারণ কী। ইহার কারণ, আমাদের দ্বারা কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নাই। কেন নাই। আমরা বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত। আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ঢেউ কাহাকেও জোরে আঘাত করিতে পারে না। সুতরাং কোনো কারণে ইহার সঙ্গে আপস করিবার কোনোই প্রয়োজন হয় না। এমন অবস্থায় আমাদের কোনো ইচ্ছা বা অনিচ্ছা আমরা যদি মনের আবেগে কিছু উচ্চকন্ঠে প্রকাশ করি তবে উচ্চ-আসনের লোকেরা সেই অশক্ত আস্ফালনকে কখনোই বরদাস্ত করিতে পারেন না। ইচ্ছার পশ্চাতে যেখানে শক্তি নাই সেখানে তাহা স্পর্ধা।
এমন অবস্থায় ক্ষতি করিবার শক্তি আমাদের কোথায় আছে তাহা একাগ্রমনে খুঁজিয়া দেখিবার ইচ্ছা হয়। ইহা স্বাভাবিক। এই ইচ্ছার তাড়নাতেই ‘স্বদেশীঁ’ উদ্যোগ হঠাৎ অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের দেশে এমন প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। আমরা তোমাদের জিনিস কিনি বলিয়া তোমাদের কাছে ৫ৼ৫০ ভারতবর্ষের এত দাম, অতএব ঐখানে আমাদের একটা শক্তি আছে। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র নাই, কিন্তু যদি আমরা এক হইয়া বলিতে পারি যে, বরং কষ্ট সহিব তবু তোমাদের জিনিস আমরা কিনিব না, তবে সেখানে তোমাদিগকে হার মানিতে হইবে।
ইহার অনেক পূর্ব হইতেই স্বদেশী সামগ্রী দেশে চালাইবার চেষ্টা ভিতরে ভিতরে নানা স্থানে নানা আকারে দেখা দিতেছিল— সুতরাং ক্ষেত্র কতকটা প্রস্তুত ছিল। তাহা না থাকিলে শুদ্ধ কেবল একটা সাময়িক রাগারাগির মাথায় এই উদ্যোগ এমন অভাবনীয় বল পাইয়া উঠিত না।
কিন্তু সশস্ত্র ও নিরস্ত্র উভয়প্রকার যুদ্ধেই নিজের শক্তি ও দলবল বিচার করিয়া চলিতে হয়। আস্ফালন করাকেই যুদ্ধ করা বলে না। তা ছাড়া এক মুহূর্তেই ‘যুদ্ধং দেহি’ বলিয়া যে পক্ষ রণক্ষেত্রে গিয়া দাঁড়ায় পরমুহুর্তেই তাহাকে ভঙ্গ দিয়া পালাইবার রাস্তা দেখিতে হয়। আমরা যখন দেশের পোলিটিকাল বক্তৃতাসভায় তাল ঠুকিয়া দাঁড়াইলাম, বলিলাম ‘এবার আমাদের লড়াই শুরু হইল’, তখন আমরা নিজের অস্ত্রশস্ত্র দলবলের কোনো হিসাবই লই নাই। তাহার প্রধান কারণ, আমরা দেশকে যে যতই ভালোবাসি-না কেন, দেশকে ঠিকমতো কেহ কোনোদিন জানি না।
চিরদিন আমাদিগকে দুর্বল বলিয়া ঘৃণা করিয়া আসাতে আমাদের প্রতিপক্ষ আমাদিগকে প্রথমে বিশেষ কোনো বাধা দেন নাই। মনে করিয়াছিলেন, এ সমস্তই কন্গ্রেসি চাল— কেবল মুখের অভিমান, কেবল বাক্যের বড়াই।
কিন্তু যখন দেখা গেল, ঠিক কন্গ্রেসের মলয়মারুতহিল্লোল নয়, দুটো একটা করিয়া লোকসানের দমকা বাড়িয়া উঠিতেছে, তখন অপর পক্ষ হইতে শাসন তাড়নের পালা পুরাদমে আরম্ভ হইল।
কিন্তু ইংরেজ আমাদিগকে যতই পর মনে করুক-না কেন, প্রজাদের প্রতি হঠাৎ উৎপাত করিতে ইংরেজ নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হয়। এ প্রকার বেআইনি ভূতের কান্ড তাহাদের রাষ্ট্রনীতিপ্রথাবিরুদ্ধ। অল্পবয়সে অধীন জাতিকে শাসন করিবার জন্য যে-সব ইংরেজ এ দেশে আসে তাহাদের মধ্যে এই ইংরেজি প্রকৃতি বিগড়িয়া যায় এবং অধীন দেশের কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে ইংরেজ জাতির মনকে আধিপত্যের নেশায় অভ্যস্ত করিয়া আনিতেছে। তবু আজিও ইংলন্ড্বাসী ইংরেজের মনে আইনের প্রতি একটা সম্ভ্রমের ভাব নষ্ট হয় নাই। এই কারণে অত্যন্ত ত্যক্ত হইয়া উঠিলেও ভারত রাজ্যশাসন ব্যাপারে হাঙ্গামার পালা সহজে আরম্ভ হয় না— ইংরেজই তাহাতে বাধা দেয়। এইজন্য ফুলার তাঁহার দলবল লইয়া একদা পূর্ববঙ্গে যেরূপ বে-ইংরাজি দাপাদাপি শুরু করিয়াছিলেন তাহা ভদ্র ইংরেজ পক্ষের দৃষ্টিতে বড়োই অশোভন হইয়া উঠিয়াছিল।