পরিশিষ্ট

আবার চরমপন্থীরাও এমনভাবে কোমর বাঁধিয়া কন‍্‌গ্রেসের রণক্ষেত্রের মধ্যে প্রবেশ করিলেন যেন, যে মধ্যমপন্থীরা এতদিন ধরিয়া কন‍্‌গ্রেসকে চালনা করিয়া আসিয়াছেন তাঁহারা এমন একটা বাধা যাহাকে ঠেলিয়া অভিভূত করিয়া চলিয়া যাইবেন— ইহাতে যাহা হয় তা হোক। এবং এটা এখনই করিতে হইবে— এইবারেই জয়ধ্বজা উড়াইয়া না গেলেই নয়। দেশের মধ্যে এবং কন‍্‌গ্রেসের সভায় মধ্যমপন্থীর স্থানটা যে কী তাহা সম্পূর্ণভাবে এবং ধীরতার সহিত স্বীকার না করিবার জন্য মনের মধ্যে যেন প্রচণ্ড আগ্রহ।

এই-যে লুব্ধতা, এই-যে অন্ধ নির্বন্ধ, ইহা যদি দলবর্তী সাধারণ লোকের মধ্যেই বদ্ধ থাকে তাহা হইলে সেটাকে মার্জনীয় বলিয়া গণ্য করা যায়— কিন্তু যাঁহারা দলের কর্তৃপদে অছেন তাঁহারাও যদি না বুঝেন কোন্‌খানে রাশ টানিলে অগ্রসর হওয়া সহজ হয় এবং কোন্‌খানে হার মানিলে তবেই যথার্থ জিতের সম্ভাবনা ঘটে, তবে ইহাই বলিতে হইবে— সংসারে যাঁহারা বড়ো জিনিসকে গড়িয়া তুলিতে পারেন, যাঁহারা কার্যসিদ্ধির লক্ষ্যকে কোনোমতেই ভুলিতে পারেন না, ইঁহারা সে দলের লোক নহেন। ইঁহারা কবির লড়াইয়ের দলের মতো উপস্থিত বাহবা ও দুয়োকে অত্যন্ত বড়ো করিয়া দেখেন— দায়িত্বদৃষ্টিকে অবিচলিত স্থৈর্যের সহিত সুদূরে প্রসারিত করেন না।

বিরুদ্ধ পক্ষের সত্তাকে যথেষ্ট সত্য বলিয়া স্বীকার না করিবার চেষ্টাতেই এবার কন‍্‌গ্রেস ভাঙিয়াছে। এক গাড়ির এঞ্জিন যদি সামনের গাড়ির এঞ্জিনকে একেবারে নাই বলিতে চায়, এমন-কি, ঠেকাঠেকি হইলেও তখনো পরস্পরকে অস্বীকার করিয়া যদি স্টীম চড়াইয়া দেওয়াকেই নিজের পথ খোলসার উপায় বলিয়া মনে করে তবে একটা চুরমার ব্যাপার না বাধিয়া থাকিতে পারে না। এ অবস্থায় যাঁহারা চালক তাঁহাদিগকে প্রশংসাপত্র দেওয়া চলে না।

মধ্যমপন্থী ও চরমপন্থী এই উভয় দলই কন‍্‌গ্রেস অধিকার করাকেই যদি দেশের কাজ করা বলিয়া একান্তভাবে না মনে করিতেন, যদি দেশের সত্যকার কর্মক্ষেত্রে ইঁহারা প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে থাকিতেন— দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অন্নের অভাব মোচন করিবার জন্য যদি ইঁহারা নিজের শক্তিকে নানা পথে অহরহ একাগ্রমনে নিয়োজিত করিয়া রাখিতেন, দেশহিতের সত্যকার সাধনা ও সত্যকার সিদ্ধি কাহাকে বলে তাহার স্বাদ যদি পাইতেন এবং দেশের জনসাধারণের সঙ্গে কায়মনোবাক্যে যোগ দিয়া দেশের প্রাণকে দেশের শক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করিতেন, তাহা হইলে কন‍্‌গ্রেস-সভার মঞ্চ জিতিয়া লইবার চেষ্টায় এমন উন্মত্ত হইয়া উঠিতেন না। কন‍্‌গ্রেসে হার হইলেও দেশের মধ্যে হার হয় না; শনৈঃ শনৈঃ প্রত্যহ প্রত্যেকের অশ্রান্ত চেষ্টায় দেশের হৃদয়ের মধ্য দিয়া পথ করিয়া চলিলে তবেই তাহাকে চলা বলে এবং সেই পথের চরম গম্যস্থান সভাপতির আসন নহে, এমন-কি, ঐ মঞ্চটা তাহার পান্থশালাও নহে।

আর যদিই মনে কর কন‍্‌গ্রেসের কর্তৃত্বলাভ দেশহিতসাধনের একটা চরিতার্থতা, তবে কি এতবড়ো একটা সম্পদকে এমন অধৈর্য ও প্রমত্ততার সহিত কাড়াকাড়ি করিতে হয়। ইহাতে যাহাকে চাই তাহাকেই কি অপমান করা হয় না।

কাজির বিচারের কথা মনে আছে? দুই স্ত্রীলোক যখন একটি ছেলেকে নিজের ছেলে বলিয়া কাজির কাছে নালিশ করিয়াছিল তখন কাজি বলিয়াছিলেন, ছেলেটাকে দুই ভাগে কাটিয়া দুইজনকে দেওয়া হউক। এই কথা শুনিয়া যথার্থ মা বলিয়া উঠিল, ‘ছেলে আমি চাই না, অপরকেই দেওয়া হউক।’ যে যথার্থ মা সে ছেলেকে নষ্ট করার চেয়ে নিজের দখল ত্যাগ করা এবং মকদ্দমায় হার-মানা অনায়াসে স্বীকার করে।

এবারকার কাজির বিচারে কী দেখা গেল। দুই দিকেরই এই জিদ যে, বরং কন‍্‌গ্রেস ভাঙিয়া যায় সেও ভালো, তবু হার মানিব না। ইহাতে এই প্রমাণ হয়, কোনো পন্থীই কন‍্‌গ্রেসকে তেমন সত্য ও তেমন বড়ো করিয়া মনে করেন না। ইহা যে একটা জীবধর্মী পদার্থ, বিচ্ছিন্ন হইলে ইহার প্রাণহানি ও আঘাত লাগিলে ইহা দুর্বল হয়, তাহা কেহ নিজের প্রাণের মধ্যে তেমন করিয়া অনুভব করেন না। তাহার কারণ কি এই নহে, এই জিনিসটাকে বিশ বৎসর তা’ দিয়াও ইহার মধ্যে প্রাণপদার্থের পরিচয় পাওয়া যায় নাই?