গোরা
হারানবাবু সুচরিতার কাছে খাটো হইয়া গেছেন।

এইরূপে নানা কারণে হারানবাবু পরেশবাবুর ঘরে দিনে দিনে নিষ্প্রভ হইয়া আসিতেছেন। বরদাসুন্দরীও যদিচ ব্রাহ্ম -অব্রাহ্মের ভেদরক্ষায় হারানবাবুর অপেক্ষা কোনো অংশে কম উৎসাহী নহেন এবং তিনিও তাঁহার স্বামীর আচরণে অনেক সময় লজ্জা বোধ করিয়া থাকেন, তথাপি হারানবাবুকে তিনি আদর্শ পুরুষ বলিয়া জ্ঞান করিতেন না। হারানবাবুর সহস্র দোষ তাঁহার চোখে পড়িত।

হারানবাবুর সাম্প্রদায়িক উৎসাহের অত্যাচারে এবং সংকীর্ণ নীরসতায় যদিও সুচরিতার মন ভিতরে ভিতরে প্রতিদিন তাঁহার উপর হইতে বিমুখ হইতেছিল, তথাপি হারানবাবুর সঙ্গেই যে তাহার বিবাহ হইবে এ সম্বন্ধে কোনো পক্ষের মনে কোনো তর্ক বা সন্দেহ ছিল না। ধর্মসামাজিক দোকানে যে ব্যক্তি নিজের উপরে খুব বড়ো অক্ষরে উচ্চ মূল্যের টিকিট মারিয়া রাখে অন্য লোকেও ক্রমে ক্রমে তাহার দুর্মূল্যতা স্বীকার করিয়া লয়। এইজন্য হারানবাবু তাঁহার মহৎসংকল্পের অনুবর্তী হইয়া যথোচিত পরীক্ষা-দ্বারা সুচরিতাকে পছন্দ করিয়া লইলেই যে সকলেই তাহা মাথা পাতিয়া লইবে, এ সম্বন্ধে হারানবাবুর এবং অন্য কাহারো মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। এমন-কি, পরেশবাবুও হারানবাবুর দাবি মনে মনে অগ্রাহ্য করেন নাই। সকলেই হারানবাবুকে ব্রাহ্মসমাজের ভাবী অবলম্বনস্বরূপ জ্ঞান করিত, তিনিও বিরুদ্ধ বিচার না করিয়া তাহাতে সায় দিতেন। এজন্য হারানবাবুর মতো লোকের পক্ষে সুচরিতা যথেষ্ট হইবে কি না ইহাই তাঁহার চিন্তার বিষয় ছিল; সুচরিতার পক্ষে হারানবাবু কী পর্যন্ত উপাদেয় হইবে তাহা তাঁহার মনেও হয় নাই।

এই বিবাহপ্রস্তাবে কেহই যেমন সুচরিতার কথাটা ভাবা আবশ্যক বোধ করে নাই, সুচরিতাও তেমনি নিজের কথা ভাবে নাই। ব্রাহ্মসমাজের সকল লোকেরই মতো সেও ধরিয়া লইয়াছিল যে হারানবাবু যেদিন বলিবেন ‘আমি এই কন্যাকে গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইয়াছি’ সেই দিনই সে এই বিবাহরূপ তাহার মহৎকর্তব্য স্বীকার করিয়া লইবে।

এই ভাবেই চলিয়া আসিতেছিল। এমন সময় সেদিন গোরাকে উপলক্ষ করিয়া হারানবাবুর সঙ্গে সুচরিতার যে দুই-চারিটি উষ্ণবাক্যের আদানপ্রদান হইয়া গেল তাহার সুর শুনিয়াই পরেশের মনে সংশয় উপস্থিত হইল যে, সুচরিতা হারানবাবুকে হয়তো যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে না— হয়তো উভয়ের স্বভাবের মধ্যে মিল না হইবার কারণ আছে। এইজন্যই বরদাসুন্দরী যখন বিবাহের জন্য তাগিদ দিতেছিলেন তখন পরেশ তাহাতে পূর্বের মতো সায় দিতে পারিলেন না। সেই দিনই বরদাসুন্দরী সুচরিতাকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া কহিলেন, “তুমি যে তোমার বাবাকে ভাবিয়ে তুলেছ।”

শুনিয়া সুচরিতা চমকিয়া উঠিল— সে যে ভুলিয়াও পরেশবাবুর উদ্‌‍বেগের কারণ হইয়া উঠিবে ইহা অপেক্ষা কষ্টের বিষয় তাহার পক্ষে কিছুই হইতে পারে না। সে মুখ বিবর্ণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, আমি কী করেছি?”

বরদাসুন্দরী। কী জানি বাছা! তাঁর মনে হয়েছে যে, তুমি পানুবাবুকে পছন্দ কর না। ব্রাহ্মসমাজের সকল লোকেই জানে পানুবাবুর সঙ্গে তোমার বিবাহ একরকম স্থির— এ অবস্থায় যদি তুমি—

সুচরিতা। কই, মা, আমি তো এ সম্বন্ধে কোনো কথাই কাউকে বলি নি!

সুচরিতার আশ্চর্য হইবার কারণ ছিল। সে হারানবাবুর ব্যবহারে বারবার বিরক্ত হইয়াছে বটে, কিন্তু বিবাহপ্রস্তাবের বিরুদ্ধে সে কোনোদিন মনেও কোনো চিন্তা করে নাই। এই বিবাহে সে সুখী হইবে কি না-হইবে সে তর্কও তাহার মনে কোনোদিন উদিত হয় নাই, কারণ, এ বিবাহ যে সুখদুঃখের দিক দিয়া বিচার্য নহে ইহাই সে জানিত।

তখন তাহার মনে পড়িল সেদিন পরেশবাবুর সামনেই পানুবাবুর প্রতি সে স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করিয়াছিল। ইহাতেই তিনি উদ্‌‍বিগ্ন হইয়াছেন মনে করিয়া তাহার হৃদয়ে আঘাত লাগিল। এমন অসংযম তো সে পূর্বে কোনোদিন প্রকাশ করে নাই, পরেও কখনো করিবে না বলিয়া মনে মনে সংকল্প করিল।