গোরা

গোরা উঠিয়া কহিল, “আজ আমরাও আসি।”

বলিয়া পরেশবাবুকে নত হইয়া নমস্কার করিল।

পরেশবাবু কহিলেন, “আজ আর তোমাদের সঙ্গে আলাপ করবার সময় পেলুম না। বাবা, যখন তোমার অবকাশ হবে মাঝে মাঝে এসো।”

গোরা ও বিনয় ঘর হইতে বাহির হইবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় বরদাসুন্দরী আসিয়া পড়িলেন। উভয়ে তাঁহাকে নমস্কার করিল। তিনি কহিলেন, “আপনারা এখনই যাচ্ছেন নাকি?”

গোরা কহিল, “হাঁ।”

বরদাসুন্দরী বিনয়কে কহিলেন, “কিন্তু বিনয়বাবু, আপনি যেতে পারছেন না— আপনাকে আজ খেয়ে যেতে হবে। আপনার সঙ্গে একটা কাজের কথা আছে।”

সতীশ লাফাইয়া উঠিয়া বিনয়ের হাত ধরিল এবং কহিল, “হাঁ মা, বিনয়বাবুকে যেতে দিয়ো না, উনি আজ রাত্রে আমার সঙ্গে থাকবেন।”

বিনয় কিছু কুণ্ঠিত হইয়া উত্তর দিতে পারিতেছিল না দেখিয়া বরদাসুন্দরী গোরাকে কহিলেন, “বিনয়বাবুকে কি আপনি নিয়ে যেতে চান? ওঁকে আপনার দরকার আছে?”

গোরা কহিল, “কিছু না। বিনয় তুমি থাকো-না— আমি আসছি।”

বলিয়া গোরা দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

বিনয়ের থাকা সম্বন্ধে বরদাসুন্দরী যখনই গোরার সম্মতি লইলেন সেই মুহূর্তেই বিনয় ললিতার মুখের দিকে না চাহিয়া থাকিতে পারিল না। ললিতা মুখ টিপিয়া হাসিয়া মুখ ফিরাইল।

ললিতার এই ছোটোখাটো হাসি-বিদ্রূপের সঙ্গে বিনয় ঝগড়া করিতেও পারে না, অথচ ইহা তাহাকে কাঁটার মতো বেঁধে। বিনয় ঘরে আসিয়া বসিতেই ললিতা কহিল, “বিনয়বাবু, আজ আপনি পালালেই ভালো করতেন।”

বিনয় কহিল, “কেন?”

ললিতা। মা আপনাকে বিপদে ফেলবার মতলব করছেন। ম্যাজিস্ট্রেটের মেলায় যে অভিনয় হবে তাতে একজন লোক কম পড়ছে— মা আপনাকে ঠিক করেছেন।

বিনয় ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কী সর্বনাশ! এ কাজ আমার দ্বারা হবে না।”

ললিতা হাসিয়া কহিল, “সে আমি মাকে আগেই বলেছি। এ অভিনয়ে আপনার বন্ধু কখনোই আপনাকে যোগ দিতে দেবেন না।”

বিনয় খোঁচা খাইয়া কহিল, “বন্ধুর কথা রেখে দিন। আমি সাত জন্মে কখনো অভিনয় করি নি— আমাকে কেন?”

ললিতা কহিল, “আমরাই বুঝি জন্মজন্মান্তর অভিনয় করে আসছি?”

এই সময় বরদাসুন্দরী ঘরের মধ্যে আসিয়া বসিলেন। ললিতা কহিল, “মা, তুমি অভিনয়ে বিনয়বাবুকে মিথ্যা ডাকছ। আগে ওঁর বন্ধুকে যদি রাজি করাতে পার তা হলে— ”

বিনয় কাতর হইয়া কহিল, “বন্ধুর রাজি হওয়া নিয়ে কথাই হচ্ছে না। অভিনয় তো করলেই হয় না— আমার যে ক্ষমতাই নেই।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সেজন্যে ভাববেন না— আমরা আপনাকে শিখিয়ে ঠিক করে নিতে পারব। ছোটো ছোটো মেয়েরা