রাজা

রোহিণী। হাঁ, ঐ যাঁর পতাকায় কিংশুক আঁকা।

সুদর্শনা। আমি তো দেখবামাত্রই চিনেছি, বরঞ্চ তোর মনে সন্দেহ এসেছিল।

রোহিণী। আমাদের যে সাহস অল্প, তাই ভয় হয়, কী জানি যদি ভুল করি তবে অপরাধ হবে।

সুদর্শনা। আহা, যদি সুরঙ্গমা থাকত তা হলে কোনো সংশয় থাকত না।

রোহিণী। সুরঙ্গমাই আমাদের সকলের চেয়ে সেয়ানা হল বুঝি!

সুদর্শনা। তা যা বলিস। সে তাঁকে ঠিক চেনে।

রোহিণী। এ কথা আমি কক্‌খনো মানব না। ও তার ভান। বললেই হল চিনি, কেউ তো পরীক্ষা করে নিতে পারবে না। আমরা যদি ওর মতো নির্লজ্জ হতুম তা হলে অমন কথা আমাদেরও মুখে আটকাত না।

সুদর্শনা। না না, সে তো বলে না কিছু।

রোহিণী। ভাব দেখায়। সে যে বলার চেয়ে আরো বেশি। কত ছলই যে জানে! ঐজন্যেই তো আমাদের কেউ তাকে দেখতে পারে না।

সুদর্শনা। যাই হোক, সে থাকলে একবার তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখতুম।

রোহিণী। সে তো কখনো কোথাও বেরোয় না— আজ দেখি সে সাজসজ্জা করে উৎসব করতে বেরিয়েছে। তার রঙ্গ দেখে হেসে বাঁচি নে।

সুদর্শনা। আজ যে প্রভুর হুকুম, তাই সে সেজেছে।

রোহিণী। তা বেশ মহারানী, আমাদের কথায় কাজ কী। যদি ইচ্ছা করেন তাকেই ডেকে আনি, তার মুখ থেকেই সন্দেহভঞ্জন হোক। তার ভাগ্য ভালো, রানীর কাছে রাজার পরিচয় সেই করিয়ে দেবে।

সুদর্শনা। না না, পরিচয় কাউকে করাতে হবে না— তবু কথাটা সকলেরই মুখে শুনতে ইচ্ছে করে।

রোহিণী। সকলেই তো বলছে— ঐ দেখো-না, তাঁর জয়ধ্বনি এখান থেকে শোনা যাচ্ছে।

সুদর্শনা। তবে এক কাজ কর্। পদ্মপাতায় করে এই ফুলগুলি তাঁর হাতে দিয়ে আয় গে।

রোহিণী। যদি জিজ্ঞাসা করেন, কে দিলে।

সুদর্শনা। তার কোনো উত্তর দিতে হবে না— তিনি ঠিক বুঝতে পারবেন। তাঁর মনে ছিল, আমি চিনতেই পারব না— ধরা পড়েছেন সেটা না জানিয়ে ছাড়ছি নে। (ফুল লইয়া রোহিণীর প্রস্থান) আমার মন আজ এমনি চঞ্চল হয়েছে— এমন তো কোনোদিন হয় না। এই পূর্ণিমার আলো মদের ফেনার মতো চারি দিকে উপচিয়ে পড়ছে, আমাকে যেন মাতাল করে তুলেছে। ওগো বসন্ত, যে-সব ভীরু, লাজুক ফুল পাতার আড়ালে গভীর রাত্রে ফোটে, যেমন করে তাদের গন্ধ উড়িয়ে নিয়ে চলেছ তেমনি তুমি আমার মনকে হঠাৎ কোথায় উদাস করে দিলে, তাকে মাটিতে পা ফেলতে দিলে না!— ওরে প্রতিহারী।

প্রতিহারী। (প্রবেশ করিয়া) কী মহারানী।

সুদর্শনা। ঐ-যে আম্রবনের বীথিকার ভিতর দিয়ে উৎসব-বালকেরা আজ গান গেয়ে যাচ্ছে— ডাক্‌ ডাক্‌, ওদের ডেকে নিয়ে আয়— একটু গান শুনি। (প্রতিহারীর প্রস্থান) ভগবান চন্দ্রমা, আজ আমার এই চঞ্চলতার উপরে তুমি যেন কেবলই কটাক্ষপাত করছ! তোমার স্মিত কৌতুকে সমস্ত আকাশ যেন ভরে গেছে— কোথাও আমার আর লুকোবার জায়গা নেই— আমি কেমন আপনার দিকে চেয়ে আপনি লজ্জা পাচ্ছি! ভয় লজ্জা সুখ দুঃখ সব মিলে আমার বুকের মধ্যে আজ নৃত্য করছে— শরীরের রক্ত নাচছে, চারি দিকের জগৎ নাচছে, সমস্ত ঝাপসা ঠেকছে।