গোরা
স্বীকার করিল না। দুই পক্ষে অনেক উত্তর চালাচালি হইলে পর সম্পাদক বলিলেন, “আমরা আর বেশি চিঠিপত্র ছাপিব না।”

কিন্তু গোরার তখন রোখ চড়িয়া গেছে। সে ‘হিণ্ডুয়িজ্‌ম্‌’ নাম দিয়া ইংরেজিতে এক বই লিখিতে লাগিল— তাহাতে তাহার সাধ্যমত সমস্ত যুক্তি ও শাস্ত্র ঘাঁটিয়া হিন্দুধর্ম ও সমাজের অনিন্দনীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ সংগ্রহ করিতে বসিয়া গেল।

এমনি করিয়া মিশনারির সঙ্গে ঝগড়া করিতে গিয়া গোরা আস্তে আস্তে নিজের ওকালতির কাছে নিজে হার মানিল। গোরা বলিল, “আমার আপন দেশকে বিদেশীর আদালতে আসামির মতো খাড়া করিয়া বিদেশীর আইনমতে তাহার বিচার করিতে আমরা দিবই না। বিলাতের আদর্শের সঙ্গে খুঁটিয়া খুঁটিয়া মিল করিয়া আমরা লজ্জাও পাইব না, গৌরবও বোধ করিব না। যে দেশে জন্মিয়াছি সে দেশের আচার, বিশ্বাস, শাস্ত্র ও সমাজের জন্য পরের ও নিজের কাছে কিছুমাত্র সংকুচিত হইয়া থাকিব না। দেশের যাহা-কিছু আছে তাহার সমস্তই সবলে ও সগর্বে মাথায় করিয়া লইয়া দেশকে ও নিজেকে অপমান হইতে রক্ষা করিব।”

এই বলিয়া গোরা গঙ্গাস্নান ও সন্ধ্যাহ্নিক করিতে লাগিল, টিকি রাখিল, খাওয়া-ছোঁওয়া সম্বন্ধে বিচার করিয়া চলিল। এখন হইতে প্রত্যহ সকালবেলায় সে বাপ-মায়ের পায়ের ধুলা লয়, যে মহিমকে সে কথায় কথায় ইংরেজি ভাষায় ‘ক্যাড’ ও ‘স্নব’ বলিয়া অভিহিত করিতে ছাড়িত না, তাহাকে দেখিলে উঠিয়া দাঁড়ায়, প্রণাম করে; মহিম এই হঠাৎ-ভক্তি লইয়া তাহাকে যাহা মুখে আসে তাহাই বলে, কিন্তু গোরা তাহার কোনো জবাব করে না।

গোরা তাহার উপদেশ ও আচরণে দেশের এক দল লোককে যেন জাগাইয়া দিল। তাহারা যেন একটা টানাটানির হাত হইতে বাঁচিয়া গেল; হাঁফ ছাড়িয়া বলিয়া উঠিল, “আমরা ভালো কি মন্দ, সভ্য কি অসভ্য তাহা লইয়া জবাবদিহি কারও কাছে করিতে চাই না— কেবল আমরা ষোলো-আনা অনুভব করিতে চাই যে আমরা আমরাই।”

কিন্তু কৃষ্ণদয়াল গোরার এই নূতন পরিবর্তনে যে খুশি হইলেন তাহা মনে হইল না। এমন-কি, তিনি একদিন গোরাকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখো বাবা, হিন্দুশাস্ত্র বড়ো গভীর জিনিস। ঋষিরা যে ধর্ম স্থাপন করে গেছেন তা তলিয়ে বোঝা যে-সে লোকের কর্ম নয়। আমার বিবেচনায় না বুঝে এ নিয়ে নাড়াচাড়া না করাই ভালো। তুমি ছেলেমানুষ, বরাবর ইংরেজি পড়ে মানুষ হয়েছ, তুমি যে ব্রাহ্মসমাজের দিকে ঝুঁকেছিলে সেটা তোমার ঠিক অধিকারের মতোই কাজ করেছিলে। সেইজন্যেই আমি তাতে কিছুই রাগ করি নি, বরঞ্চ খুশিই ছিলুম। কিন্তু এখন তুমি যে পথে চলেছ এটা ঠিক ভালো ঠেকছে না। এ তোমার পথই নয়।”

গোরা কহিল, “বলেন কী বাবা? আমি যে হিন্দু। হিন্দুধর্মের গূঢ় মর্ম আজ না বুঝি তো কাল বুঝব— কোনোকালে যদি না বুঝি তবু এই পথে চলতেই হবে। হিন্দুসমাজের সঙ্গে পূর্বজন্মের সম্বন্ধ কাটাতে পারি নি বলেই তো এ জন্মে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছি, এমনি করেই জন্মে জন্মে এই হিন্দুধর্মের ও হিন্দুসমাজের ভিতর দিয়েই অবশেষে এর চরমে উত্তীর্ণ হব। যদি কখনো ভুলে অন্য পথের দিকে একটু হেলি আবার দ্বিগুণ জোরে ফিরতেই হবে।”

কৃষ্ণদয়াল কেবলই মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিলেন, “কিন্তু, বাবা, হিন্দু বললেই হিন্দু হওয়া যায় না। মুসলমান হওয়া সোজা, খৃস্টান যে-সে হতে পারে— কিন্তু হিন্দু! বাস্‌‍ রে! ও বড়ো শক্ত কথা।

গোরা। সে তো ঠিক। কিন্তু আমি যখন হিন্দু হয়ে জন্মেছি, তখন তো সিংহদ্বার পার হয়ে এসেছি। এখন ঠিকমত সাধন করে গেলেই অল্পে অল্পে এগোতে পারব।

কৃষ্ণদয়াল। বাবা, তর্কে তোমাকে ঠিকটি বোঝাতে পারব না। তবে তুমি যা বলছ সেও সত্য। যার যেটা কর্মফল, নির্দিষ্ট ধর্ম, তাকে একদিন ঘুরে ফিরে সেই ধর্মের পথেই আসতে হবে— কেউ আটকাতে পারবে না। ভগবানের ইচ্ছে। আমরা কী করতে পারি! আমরা তো উপলক্ষ।

কর্মফল এবং ভগবানের ইচ্ছা, সোহহংবাদ এবং ভক্তিতত্ত্ব সমস্তই কৃষ্ণদয়াল সম্পূর্ণ সমান ভাবে গ্রহণ করেন— পরস্পরের