গোরা
বসাইলেন। একটি ছোটো টেবিল, তাহার এক ধারে পিঠওয়ালা বেঞ্চি, অন্য ধারে একটা কাঠের ও বেতের চৌকি; দেয়ালে এক দিকে যিশুখৃস্টের একটি রঙ-করা ছবি এবং অন্য দিকে কেশববাবুর ফোটোগ্রাফ। টেবিলের উপর দুই-চারি দিনের খবরের কাগজ ভাঁজ করা, তাহার উপরে সীসার কাগজ-চাপা। কোণে একটি ছোটো আলমারি, তাহার উপরের থাকে থিয়োডোর পার্কারের বই সারি সারি সাজানো রহিয়াছে দেখা যাইতেছে। আলমারির মাথার উপরে একটি গ্লোব কাপড় দিয়া ঢাকা রহিয়াছে।

বিনয় বসিল; তাহার বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল; মনে হইতে লাগিল তাহার পিঠের দিকের খোলা দরজা দিয়া যদি কেহ ঘরের ভিতরে আসিয়া প্রবেশ করে।

পরেশ কহিলেন, “সোমবারে সুচরিতা আমার একটি বন্ধুর মেয়েকে পড়াতে যায়, সেখানে সতীশের একটি সমবয়সী ছেলে আছে তাই সতীশও তার সঙ্গে গেছে। আমি তাদের সেখানে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছি। আর একটু দেরি হলেই তো আপনার সঙ্গে দেখা হত না।”

খবরটা শুনিয়া বিনয় একই কালে একটা আশাভঙ্গের খোঁচা এবং আরাম মনের মধ্যে অনুভব করিল। পরেশের সঙ্গে তাহার কথাবার্তা দিব্য সহজ হইয়া আসিল।

গল্প করিতে করিতে একে একে পরেশ আজ বিনয়ের সমস্ত খবর জানিতে পারিলেন। বিনয়ের বাপ-মা নাই; খুড়িমাকে লইয়া খুড়া দেশে থাকিয়া বিষয়কর্ম দেখেন। তাহার খুড়তুতো দুই ভাই তাহার সঙ্গে এক বাসায় থাকিয়া পড়াশুনা করিত— বড়োটি উকিল হইয়া তাহাদের জেলা-কোর্টে ব্যবসায় চালাইতেছে, ছোটোটি কলিকাতায় থাকিতেই ওলাউঠা হইয়া মারা গিয়াছে; খুড়ার ইচ্ছা বিনয় ডেপুটি ম্যাজিস্‌‍ট্রেটির চেষ্টা করে, কিন্তু বিনয় কোনো চেষ্টাই না করিয়া নানা বাজে কাজে নিযুক্ত আছে।

এমনি করিয়া প্রায় এক ঘণ্টা কাটিয়া গেল। বিনা প্রয়োজনে আর বেশিক্ষণ থাকিলে অভদ্রতা হয়, তাই বিনয় উঠিয়া পড়িল; কহিল, “বন্ধু সতীশের সঙ্গে আমার দেখা হল না, দুঃখ রইল; তাকে খবর দেবেন আমি এসেছিলুম।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আর-একটু বসলেই তাদের সঙ্গে দেখা হত। তাদের ফেরবার বড়ো আর দেরি নেই।”

এই কথাটুকুর উপরে নির্ভর করিয়া আবার বসিয়া পড়িতে বিনয়ের লজ্জা বোধ হইল। আর-একটু পীড়াপীড়ি করিলে সে বসিতে পারিত— কিন্তু পরেশ অধিক কথা বলিবার বা পীড়াপীড়ি করিবার লোক নহেন, সুতরাং বিদায় লইতে হইল। পরেশ বলিলেন, “আপনি মাঝে মাঝে এলে খুশি হব।”

রাস্তায় বাহির হইয়া বিনয় বাড়ির দিকে ফিরিবার কোনো প্রয়োজন অনুভব করিল না। সেখানে কোনো কাজ নাই। বিনয় কাগজে লিখিয়া থাকে— তাহার ইংরেজি লেখার সকলে খুব তারিফ করে, কিন্তু গত কয়দিন হইতে লিখিতে বসিলে লেখা মাথায় আসে না। টেবিলের সামনে বেশিক্ষণ বসিয়া থাকাই দায়— মন ছট্‌ফট্‌ করিয়া উঠে। বিনয় তাই আজ বিনা কারণেই উলটা দিকে চলিল।

দু পা যাইতেই একটি বালক-কণ্ঠের চীৎকারধ্বনি শুনিতে পাইল, “বিনয়বাবু, বিনয়বাবু!”

মুখ তুলিয়া দেখিল একটি ভাড়াটে গাড়ির দরজার কাছে ঝুঁকিয়া পড়িয়া সতীশ তাহাকে ডাকাডাকি করিতেছে। গাড়ির ভিতরের আসনে খানিকটা শাড়ি, খানিকটা সাদা জামার আস্তিন, যেটুকু দেখা গেল তাহাতে আরোহীটি যে কে তাহা বুঝিতে কোনো সন্দেহ রহিল না।

বাঙালি ভদ্রতার সংস্কার অনুসারে গাড়ির দিকে দৃষ্টি রক্ষা করা বিনয়ের পক্ষে শক্ত হইয়া উঠিল। ইতিমধ্যে সেইখানেই গাড়ি হইতে নামিয়া সতীশ আসিয়া তাঁহার হাত ধরিল; কহিল, “চলুন আমাদের বাড়ি।”

বিনয় কহিল, “আমি যে তোমাদের বাড়ি থেকে এখনই আসছি।”