গোরা
পড়িয়া গেল।

সান্ধ্য উপাসনা শেষ করিয়া পরেশ ছাতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া গোরা ও হারান উভয়েই লজ্জিত হইয়া ক্ষান্ত হইল। গোরা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “রাত হয়ে গেছে, আজ তবে আসি।”

বিনয়ও ঘর হইতে বিদায় লইয়া ছাতে আসিয়া দেখা দিল। পরেশ গোরাকে কহিলেন, “দেখো, তোমার যখন ইচ্ছা এখানে এসো। কৃষ্ণদয়াল আমার ভাইয়ের মতো ছিলেন। তাঁর সঙ্গে এখন আমার মতের মিল নেই, দেখাও হয় না, চিঠিপত্র লেখাও বন্ধ আছে, কিন্তু ছেলেবেলার বন্ধুত্ব রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে থাকে। কৃষ্ণদয়ালের সম্পর্কে তোমার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ অতি নিকটের। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।”

পরেশের সস্নেহ শান্ত কণ্ঠস্বরে গোরার এতক্ষণকার তর্কতাপ যেন জুড়াইয়া গেল। প্রথমে আসিয়া গোরা পরেশকে বড়ো একটা খাতির করে নাই। যাইবার সময় যথার্থ ভক্তির সঙ্গে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া গেল। সুচরিতাকে গোরা কোনোপ্রকার বিদায়সম্ভাষণ করিল না। সুচরিতা যে সম্মুখে আছে ইহা কোনো আচরণের দ্বারা স্বীকার করাকেই সে অশিষ্টতা বলিয়া গণ্য করিল। বিনয় পরেশকে নতভাবে প্রণাম করিয়া সুচরিতার দিকে ফিরিয়া তাহাকে নমস্কার করিল এবং লজ্জিত হইয়া তাড়াতাড়ি গোরার অনুসরণ করিয়া বাহির হইয়া গেল।

হারান এই বিদায়সম্ভাষণ-ব্যাপার এড়াইয়া ঘরের মধ্যে গিয়া টেবিলের উপরকার একটি ‘ব্রহ্মসংগীত’ বই লইয়া তাহার পাতা উলটাইতে লাগিলেন।

বিনয় ও গোরা চলিয়া যাইবামাত্র হারান দ্রুতপদে ছাতে আসিয়া পরেশকে কহিলেন, “দেখুন, সকলের সঙ্গেই মেয়েদের আলাপ করিয়ে দেওয়া আমি ভালো মনে করি নে।”

সুচরিতা ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিল, তাই সে ধৈর্য সংবরণ করিতে পারিল না; কহিল, “বাবা যদি সে নিয়ম মানতেন তা হলে তো আপনার সঙ্গেও আমাদের আলাপ হতে পারত না।”

হারান কহিলেন, “আলাপ-পরিচয় নিজেদের সমাজের মধ্যেই বদ্ধ হলে ভালো হয়।”

পরেশ হাসিয়া কহিলেন, “আপনি পারিবারিক অন্তঃপুরকে আর-একটুখানি বড়ো করে একটা সামাজিক অন্তঃপুর বানাতে চান। কিন্তু আমি মনে করি নানা মতের ভদ্রলোকের সঙ্গে মেয়েদের মেশা উচিত; নইলে তাদের বুদ্ধিকে জোর করে খর্ব করে রাখা হয়। এতে ভয় কিংবা লজ্জার কারণ তো কিছুই দেখি নে।”

হারান। ভিন্ন মতের লোকের সঙ্গে মেয়েরা মিশবে না এমন কথা বলি নে, কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করতে হয় সে ভদ্রতা যে এঁরা জানেন না।

পরেশ। না না, বলেন কী। ভদ্রতার অভাব আপনি যাকে বলছেন সে একটা সংকোচমাত্র— মেয়েদের সঙ্গে না মিশলে সেটা কেটে যায় না।

সুচরিতা উদ্ধত ভাবে কহিল, “দেখুন পানুবাবু, আজকের তর্কে আমাদের সমাজের লোকের ব্যবহারেই আমি লজ্জিত হচ্ছিলুম।”

ইতিমধ্যে লীলা দৌড়িয়া আসিয়া “দিদি” “দিদি” করিয়া সুচরিতার হাত ধরিয়া তাহাকে ঘরে টানিয়া লইয়া গেল।