প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
ললিতা রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “কেন তুমি এত দেরি করলে? জান এগারোটা বেজেছে। আমি সমস্ত ঘড়ি শুনেছি। এখনই তো তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।”
সুচরিতা ললিতাকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া কহিল, “আজ আমার অন্যায় হয়ে গেছে ভাই।”
যেমনি অপরাধ স্বীকার করা ললিতার আর রাগ রহিল না। একেবারে নরম হইয়া কহিল, “এতক্ষণ একলা বসে কার কথা ভাবছিলে দিদি? পানুবাবুর কথা?”
তাহাকে তর্জনী দিয়া আঘাত করিয়া সুচরিতা কহিল, “দূর!”
পানুবাবুকে ললিতা সহিতে পারিত না। এমন-কি, তাহার অন্য বোনের মতো তাহাকে লইয়া সুচরিতাকে ঠাট্টা করাও তাহার পক্ষে অসাধ্য ছিল। পানুবাবু সুচরিতাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন, এ কথা মনে করিলে তাহার রাগ হইত।
একটুখানি চুপ করিয়া ললিতা কথা তুলিল, “আচ্ছা দিদি, বিনয়বাবু লোকটি কিন্তু বেশ। না?”
সুচরিতার মনের ভাবটা যাচাই করিবার উদ্দেশ্য যে এ প্রশ্নের মধ্যে ছিল না, তাহা বলিতে পারি না।
সুচরিতা কহিল, “হাঁ, বিনয়বাবু লোকটি ভালো বৈকি— বেশ ভালোমানুষ।”
ললিতা যে সুর আশা করিয়াছিল তাহা তো সম্পূর্ণ বাজিল না। তখন সে আবার কহিল, “কিন্তু যাই বল দিদি, আমার গৌরমোহনবাবুকে একেবারেই ভালো লাগে নি। কী রকম কটা কটা রঙ, কাঠখোট্টা চেহারা, পৃথিবীর কাউকে যেন গ্রাহ্যই করেন না। তোমার কী রকম লাগল?”
সুচরিতা কহিল, “বড়ো বেশি রকম হিঁদুয়ানি।”
ললিতা কহিল, “না, না, আমাদের মেসোমশায়ের তো খুবই হিঁদুয়ানি, কিন্তু সে আর-এক রকমের। এ যেন— ঠিক বলতে পারি নে কী রকম।”
সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “কী রকমই বটে।” বলিয়া গোরার সেই উচ্চ শুভ্র ললাটে তিলক-কাটা মূর্তি মনে আনিয়া সুচরিতা রাগ করিল। রাগ করিবার কারণ এই যে, ঐ তিলকের দ্বারা গোরা কপালে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখিয়া রাখিয়াছে যে তোমাদের হইতে আমি পৃথক। সেই পার্থক্যের প্রচণ্ড অভিমানকে সুচরিতা যদি ধূলিসাৎ করিয়া দিতে পারিত তবেই তাহার গায়ের জ্বালা মিটিত।
আলোচনা বন্ধ হইল, ক্রমে দুইজনে ঘুমাইয়া পড়িল। রাত্রি যখন দুইটা সুচরিতা জাগিয়া দেখিল, বাহিরে ঝম্ ঝম্ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে; মাঝে মাঝে তাহাদের মশারির আবরণ ভেদ করিয়া বিদ্যুতের আলো চমকিয়া উঠিতেছে; ঘরের কোণে যে প্রদীপ ছিল সেটা নিবিয়া গেছে। সেই রাত্রির নিস্তব্ধতায়, অন্ধকারে, অবিশ্রাম বৃষ্টির শব্দে, সুচরিতার মনের মধ্যে একটা বেদনা বোধ হইতে লাগিল। সে এপাশ ওপাশ করিয়া ঘুমাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিল— পাশেই ললিতাকে গভীর সুপ্তিতে মগ্ন দেখিয়া তাহার ঈর্ষা জন্মিল, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসিল না। বিরক্ত হইয়া সে বিছানা ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল। খোলা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া সম্মুখের ছাতের দিকে চাহিয়া রহিল— মাঝে মাঝে বাতাসের বেগে গায়ে বৃষ্টির ছাট লাগিতে লাগিল। ঘুরিয়া ফিরিয়া আজ সন্ধ্যাবেলাকার সমস্ত ব্যাপারে তন্ন তন্ন করিয়া তাহার মনে উদয় হইল। সেই সূর্যাস্তরঞ্জিত গাড়িবারান্দার উপর গোরার উদ্দীপ্ত মুখ স্পষ্ট ছবির মতো তাহার স্মৃতিতে জাগিয়া উঠিল এবং তখন তর্কের যে-সমস্ত কথা কানে শুনিয়া ভুলিয়া গিয়াছিল সে সমস্তই গোরার গভীর প্রবল কণ্ঠস্বরে জড়িত হইয়া আগাগোড়া তাহার মনে পড়িল। কানে বাজিতে লাগিল, “আপনারা যাদের অশিক্ষিত বলেন আমি তাদেরই দলে, আপনারা যাকে কুসংস্কার বলেন আমার সংস্কার তাই। যতক্ষণ না আপনি দেশকে ভালোবাসবেন এবং দেশের লোকের সঙ্গে এক জায়গায় এসে দাঁড়াতে পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার মুখ থেকে দেশের নিন্দা আমি এক বর্ণও সহ্য করতে পারব না।” এ