প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
অবিনাশ আসিয়া পড়াতে গোরার সঙ্গে মিলন-ব্যাপারে বিনয় বাধা পাইল। সে তখন উঠিয়া উপরে গেল। আনন্দময়ী তাঁহার ভাঁড়ার-ঘরের সম্মুখের বারান্দায় বসিয়া তরকারি কুটিতেছিলেন।
আনন্দময়ী কহিলেন, “অনেকক্ষণ থেকে তোমাদের গলা শুনতে পাচ্ছি। এত সকালে যে? জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছ তো?”
অন্য দিন হইলে বিনয় বলিত, না, খাই নাই— এবং আনন্দময়ীর সম্মুখে বসিয়া তাহার আহার জমিয়া উঠিত। কিন্তু আজ বলিল, “না মা, খাব না— খেয়েই বেরিয়েছি।”
আজ বিনয় গোরার কাছে অপরাধ বাড়াইতে ইচ্ছা করিল না। পরেশবাবুর সঙ্গে তাহার সংস্রবের জন্য গোরা যে এখনো তাহাকে ক্ষমা করে নাই, তাহাকে একটু যেন দূরে ঠেলিয়া রাখিতেছে, ইহা অনুভব করিয়া তাহার মনের ভিতরে ভিতরে একটা ক্লেশ হইতেছিল। সে পকেট হইতে ছুরি বাহির করিয়া আলুর খোসা ছাড়াইতে বসিয়া গেল।
মিনিট পনেরো পরে নীচে গিয়া দেখিল গোরা অবিনাশকে লইয়া বাহির হইয়া গেছে। গোরার ঘরে বিনয় অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার পরে খবরের কাগজ হাতে লইয়া শূন্যমনে বিজ্ঞাপন দেখিতে লাগিল। তাহার পর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বাহির হইয়া চলিয়া গেল।
মধ্যাহ্নে গোরার কাছে যাইবার জন্য বিনয়ের মন আবার চঞ্চল হইয়া উঠিল। বিনয় গোরার কাছে নিজেকে নত করিতে কোনোদিন সংকোচ বোধ করে নাই। কিন্তু নিজের অভিমান না থাকিলেও বন্ধুত্বের অভিমানকে ঠেকানো শক্ত। পরেশবাবুর কাছে ধরা দিয়া বিনয় গোরার প্রতি তাহার এতদিনকার নিষ্ঠায় একটু যেন খাটো হইয়াছে বলিয়া অপরাধ অনুভব করিতেছিল বটে, কিন্তু সেজন্য গোরা তাহাকে পরিহাস ও ভর্ৎসনা করিবে এই পর্যন্তই আশা করিয়াছিল, তাহাকে যে এমন করিয়া ঠেলিয়া রাখিবার চেষ্টা করিবে তাহা সে মনেও করে নাই। বাসা হইতে খানিকটা দূর বাহির হইয়া বিনয় আবার ফিরিয়া আসিল; বন্ধুত্ব পাছে অপমানিত হয় এই ভয়ে সে গোরার বাড়িতে যাইতে পারিল না।
মধ্যাহ্নে আহারের পর গোরাকে একখানা চিঠি লিখিবে বলিয়া কাগজ কলম লইয়া বিনয় বসিয়াছে; বসিয়া অকারণে কলমটাকে ভোঁতা অপবাদ দিয়া একটা ছুরি লইয়া অতিশয় যত্নে একটু একটু করিয়া তাহার সংস্কার করিতে লাগিয়াছে, এমন সময়ে নীচে হইতে “বিনয়” বলিয়া ডাক আসিল। বিনয় কলম ফেলিয়া তাড়াতাড়ি নীচে গিয়া বলিল, “মহিমদাদা, আসুন, উপরে আসুন।”
মহিম উপরের ঘরে আসিয়া বিনয়ের খাটের উপর বেশ চৌকা হইয়া বসিলেন এবং ঘরের আসবাবপত্র বেশ ভালো করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “দেখো বিনয়, তোমার বাসা যে আমি চিনি নে তা নয়— মাঝে মাঝে তোমার খবর নিয়ে যাই এমন ইচ্ছাও করে, কিন্তু আমি জানি তোমরা আজকালকার ভালো ছেলে, তোমাদের এখানে তামাকটি পাবার জো নেই, তাই বিশেষ প্রয়োজন না হলে—”
বিনয়কে ব্যস্ত হইয়া উঠিতে দেখিয়া মহিম কহিলেন, “তুমি ভাবছ এখনই বাজার থেকে নতুন হুঁকো কিনে এনে আমাকে তামাক খাওয়াবে, সে চেষ্টা কোরো না। তামাক না দিলে ক্ষমা করতে পারব কিন্তু নতুন হুঁকোয় আনাড়ি হাতের সাজা তামাক আমার সহ্য হবে না।”
এই বলিয়া মহিম বিছানা হইতে একটা হাতপাখা তুলিয়া লইয়া হাওয়া খাইতে খাইতে কহিলেন, “আজ রবিবারের