প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
হারানবাবু সুচরিতার এই তদগত ভাব লক্ষ্য করিয়াছিলেন। তাহাতে তাঁহার তর্কের যুক্তিগুলি জোর পাইতেছিল না। অবশেষে এক সময় নিতান্ত অধীর হইয়া তিনি আসন ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িলেন এবং সুচরিতাকে নিতান্ত আত্মীয়ের মতো ডাকিয়া কহিলেন, “সুচরিতা, একবার এ ঘরে এসো, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।”
সুচরিতা একেবারে চমকিয়া উঠিল। তাহাকে কে যেন মারিল। হারানবাবুর সহিত তাহার যেরূপ সম্বন্ধ তাহাতে তিনি যে কখনো তাহাকে এরূপ আহ্বান করিতে পারেন না তাহা নহে। অন্য সময় হইলে সে কিছু মনেই করিত না; কিন্তু আজ গোরা ও বিনয়ের সম্মুখে সে নিজেকে অপমানিত বোধ করিল। বিশেষত গোরা তাহার মুখের দিকে এমন একরকম করিয়া চাহিল যে, সে হারানবাবুকে ক্ষমা করিতে পারিল না। প্রথমটা, সে যেন কিছুই শুনিতে পায় নাই এমনিভাবে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। হারানবাবু তখন কণ্ঠস্বরে একটু বিরক্তি প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “শুনছ সুচরিতা? আমার একটা কথা আছে, একবার এ ঘরে আসতে হবে।”
সুচরিতা তাঁহার মুখের দিকে না তাকাইয়াই কহিল, “এখন থাক্— বাবা আসুন, তার পরে হবে।”
বিনয় উঠিয়া কহিল, “আমরা নাহয় যাচ্ছি।”
সুচরিতা তাড়াতাড়ি কহিল, “না বিনয়বাবু, উঠবেন না। বাবা আপনাদের থাকতে বলেছেন। তিনি এলেন বলে।” তাহার কণ্ঠস্বরে একটা ব্যাকুল অনুনয়ের ভাব প্রকাশ পাইল। হরিণীকে যেন ব্যাধের হাতে ফেলিয়া যাইবার প্রস্তাব হইয়াছিল।
“আমি আর থাকতে পারছি নে, আমি তবে চললুম” বলিয়া হারানবাবু দ্রুতপদে ঘর হইতে চলিয়া গেলেন। রাগের মাথায় বাহির হইয়া আসিয়া পরক্ষণেই তাঁহার অনুতাপ হইতে লাগিল, কিন্তু তখন ফিরিবার আর কোনো উপলক্ষ খুঁজিয়া পাইলেন না।
হারানবাবু চলিয়া গেলে সুচরিতা একটা কোন্ সুগভীর লজ্জায় মুখ যখন রক্তিম ও নত করিয়া বসিয়া ছিল, কী করিবে কী বলিবে কিছুই ভাবিয়া পাইতেছিল না, সেই সময়ে গোরা তাহার মুখের দিকে ভালো করিয়া চাহিয়া লইবার অবকাশ পাইয়াছিল। গোরা শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে যে ঔদ্ধত্য, যে প্রগল্ভতা কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিল, সুচরিতার মুখশ্রীতে তাহার আভাসমাত্র কোথায়! তাহার মুখে বুদ্ধির একটা উজ্জ্বলতা নিঃসন্দেহ প্রকাশ পাইতেছিল, কিন্তু নম্রতা ও লজ্জার দ্বারা তাহা কী সুন্দর কোমল হইয়া আজ দেখা দিয়াছে! মুখের ডৌলটি কী সুকুমার! ভ্রূযুগলের উপরে ললাটটি যেন শরতের আকাশখণ্ডের মতো নির্মল ও স্বচ্ছ। ঠোঁট দুটি চুপ করিয়া আছে, কিন্তু অনুচ্চারিত কথার মাধুর্য সেই দুটি ঠোঁটের মাঝখানে যেন কোমল একটি কুঁড়ির মতো রহিয়াছে। নবীনা রমণীর বেশভূষার প্রতি গোরা পূর্বে কোনোদিন ভালো করিয়া চাহিয়া দেখে নাই এবং না দেখিয়াই সে-সমস্তের প্রতি তাহার একটা ধিক্কারভাব ছিল— আজ সুচরিতার দেহে তাহার নূতন ধরনের শাড়ি পরার ভঙ্গি তাহার একটু বিশেষভাবে ভালো লাগিল; সুচরিতার একটি হাত টেবিলের উপরে ছিল— তাহার জামার আস্তিনের কুঞ্চিত প্রান্ত হইতে সেই হাতখানি আজ গোরার চোখে কোমল হৃদয়ের একটি কল্যাণপূর্ণ বাণীর মতো বোধ হইল। দীপালোকিত শান্ত সন্ধ্যায় সুচরিতাকে বেষ্টন করিয়া সমস্ত ঘরটি তাহার আলো, তাহার দেয়ালের ছবি, তাহার গৃহসজ্জা, তাহার পারিপাট্য লইয়া একটি যেন বিশেষ অখণ্ড রূপ ধারণ করিয়া দেখা দিল। তাহা যে গৃহ, তাহা যে সেবাকুশলা নারীর যত্নে স্নেহে সৌন্দর্যে মণ্ডিত, তাহা যে দেয়াল ও কড়ি বরগা ছাদের চেয়ে অনেক বেশি— ইহা আজ গোরার কাছে মুহূর্তের মধ্যে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিল। গোরা আপনার চতুর্দিকের আকাশের মধ্যে একটা সজীব সত্তা অনুভব করিল— তাহার হৃদয়কে চারি দিক হইতেই একটা হৃদয়ের হিল্লোল আসিয়া আঘাত করিতে লাগিল, একটা কিসের নিবিড়তা তাহাকে যেন বেষ্টন করিয়া ধরিল। এরূপ অপূর্ব উপলব্ধি তাহার জীবনে কোনোদিন ঘটে নাই। দেখিতে দেখিতে ক্রমশই সুচরিতার কপালের ভ্রষ্ট কেশ হইতে তাহার পায়ের কাছে শাড়ির পাড়টুকু পর্যন্ত অত্যন্ত সত্য এবং অত্যন্ত বিশেষ হইয়া উঠিল। একই কালে