প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
সেদিন নীচে গিয়া এই পরামর্শ হইল যে, গোরা তাহার দলের দুই-তিন জনকে সঙ্গে করিয়া পায়ে হাঁটিয়া গ্রাণ্ড্ ট্রাঙ্ক্ রোড দিয়া ভ্রমণে বাহির হইবে; পথের মধ্যে গৃহস্থবাড়ি আতিথ্য গ্রহণ করিবে, সঙ্গে টাকাকড়ি কিছুই লইবে না।
এই অপূর্ব সংকল্প মনে লইয়া গোরা হঠাৎ কিছু অতিরিক্ত পরিমাণে উৎসাহিত হইয়া উঠিল। সমস্ত বন্ধন ছেদন করিয়া এইরূপ খোলা রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িবার একটা প্রবল আনন্দ তাহাকে পাইয়া বসিল। ভিতরে ভিতরে তাহার হৃদয় যে একটা জালে জড়াইয়া পড়িয়াছে, এই বাহির হইবার কল্পনাতেই সেটা যেন ছিন্ন হইয়া গেল বলিয়া তাহার মনে হইল। এই-সমস্ত ভাবের আবেশ যে মায়ামাত্র এবং কর্মই যে সত্য সেই কথাটা খুব জোরের সহিত নিজের মনের মধ্যে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করিয়া লইয়া যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইয়া লইবার জন্য ইস্কুল-ছুটির বালকের মতো গোরা তাহার একতলার বসিবার ঘর ছাড়িয়া প্রায় ছুটিয়া বাহির হইল। সেই সময় কৃষ্ণদয়াল গঙ্গাস্নান সারিয়া ঘটিতে গঙ্গাজল লইয়া নামাবলী গায়ে দিয়া মনে মনে মন্ত্র জপ করিতে করিতে ঘরে চলিয়াছিলেন। গোরা একেবারে তাঁহার ঘাড়ের উপর গিয়া পড়িল। লজ্জিত হইয়া গোরা তাড়াতাড়ি তাঁহার পা ছুঁইয়া প্রণাম করিল। তিনি শশব্যস্ত হইয়া ‘থাক্ থাক্’ বলিয়া সসংকোচে চলিয়া গেলেন। পূজায় বসিবার পূর্বে গোরার স্পর্শে তাঁহার গঙ্গাস্নানের ফল মাটি হইল। কৃষ্ণদয়াল যে গোরার সংস্পর্শই বিশেষ করিয়া এড়াইয়া চলিবার চেষ্টা করিতেন গোরা তাহা ঠিক বুঝিত না; সে মনে করিত শুচিবায়ুগ্রস্ত বলিয়া সর্বপ্রকারে সকলেরই সংস্রব বাঁচাইয়া চলাই অহরহ তাঁহার সতর্কতার একমাত্র লক্ষ্য ছিল; আনন্দময়ীকে তো তিনি ম্লেচ্ছ বলিয়া দূরে পরিহার করিতেন— মহিম কাজের লোক, মহিমের সঙ্গে তাঁহার দেখা সাক্ষাতেরই অবকাশ ঘটিত না। সমস্ত পরিবারের মধ্যে কেবল মহিমের কন্যা শশিমুখীকে তিনি কাছে লইয়া তাহাকে সংস্কৃত স্তোত্র মুখস্থ করাইতেন এবং পূজার্চনাবিধিতে দীক্ষিত করিতেন।
কৃষ্ণদয়াল গোরাকর্তৃক তাঁহার পাদস্পর্শে ব্যস্ত হইয়া পলায়ন করিলে পর তাঁহার সংকোচের কারণ সম্বন্ধে গোরার চেতনা হইল এবং সে মনে মনে হাসিল। এইরূপে পিতার সহিত গোরার সমস্ত সম্বন্ধ প্রায় বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল এবং মাতার অনাচারকে সে যতই নিন্দা করুক এই আচারদ্রোহিনী মাকেই গোরা তাহার জীবনের সমস্ত ভক্তি সমর্পণ করিয়া পূজা করিত।
আহারান্তে গোরা একটি ছোটো পুঁটলিতে গোটাকয়েক কাপড় লইয়া সেটা বিলাতি পর্যটকদের মতো পিঠে বাঁধিয়া মার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, “মা, আমি কিছুদিনের মতো বেরোব।”
আনন্দময়ী কহিলেন, “কোথায় যাবে বাবা?”
গোরা কহিল, “সেটা আমি ঠিক বলতে পারছি নে।”
আনন্দময়ী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোনো কাজ আছে?”
গোরা কহিল, “কাজ বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু নয়— এই যাওয়াটাই একটা কাজ।”
আনন্দময়ীকে একটুখানি চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া গোরা কহিল, “মা, দোহাই তোমার, আমাকে বারণ করতে পারবে না। তুমি তো আমাকে জানই, আমি সন্ন্যাসী হয়ে যাব এমন ভয় নেই। আমি মাকে ছেড়ে বেশি দিন কোথাও থাকতে পারি নে।”
মার প্রতি তাহার ভালোবাসা গোরা কোনোদিন মুখে এমন করিয়া বলে নাই— তাই আজ কথাটা বলিয়াই সে লজ্জিত হইল।