গোরা
নিজের পক্ষের যুক্তিকে দুর্বল অনুভব করিয়াই ললিতা অকারণ বিদ্রূপের খোঁচায় বিনয়কে কথায় কথায় আহত করিতে লাগিল।

শেষকালে বিনয় কহিল, “দেখুন, আপনি তর্ক করছেন কেন? আপনি বলুন-না কেন, ‘আমার ইচ্ছা, আপনি অভিনয়ে যোগ দেন।’ তা হলে আমি আপনার অনুরোধরক্ষার খাতিরে নিজের মতটাকে বিসর্জন দিয়ে একটা সুখ পাই।”

ললিতা কহিল, “বাঃ, তা আমি কেন বলব? সত্যি যদি আপনার কোনো মত থাকে তা হলে সেটা আমার অনুরোধে কেন ত্যাগ করতে যাবেন? কিন্তু সেটা সত্যি হওয়া চাই।”

বিনয় কহিল, “আচ্ছা, সেই কথাই ভালো। আমার সত্যিকার কোনো মত নেই। আপনার অনুরোধে নাই হল, আপনার তর্কেই পরাস্ত হয়ে আমি অভিনয়ে যোগ দিতে রাজি হলুম।”

এমন সময় বরদাসুন্দরী ঘরে প্রবেশ করিবামাত্রই বিনয় উঠিয়া গিয়া তাঁহাকে কহিল, “অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হলে আমাকে কী করতে হবে বলে দেবেন।”

বরদাসুন্দরী সগর্বে কহিলেন, “সেজন্যে আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না, আমরা আপনাকে ঠিক তৈরি করে নিতে পারব। কেবল অভ্যাসের জন্য রোজ আপনাকে নিয়মিত আসতে হবে।”

বিনয় কহিল, “আচ্ছা। আজ তবে আসি।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সে কী কথা? আপনাকে খেয়ে যেতে হচ্ছে।”

বিনয় কহিল, “আজ নাই খেলুম।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “না না, সে হবে না।”

বিনয় খাইল, কিন্তু অন্য দিনের মতো তাহার স্বাভাবিক প্রফুল্লতা ছিল না। আজ সুচরিতাও কেমন অন্যমনস্ক হইয়া চুপ করিয়া ছিল। যখন ললিতার সঙ্গে বিনয়ের লড়াই চলিতেছিল তখন সে বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতেছিল। আজ রাত্রে কথাবার্তা আর জমিল না।

বিদায়ের সময় বিনয় ললিতার গম্ভীর মুখ লক্ষ্য করিয়া কহিল, “আমি হার মানলুম, তবু আপনাকে খুশি করতে পারলুম না।”

ললিতা কোনো জবাব না দিয়া চলিয়া গেল।

ললিতা সহজে কাঁদিতে জানে না, কিন্তু আজ তাহার চোখ দিয়া জল যেন ফাটিয়া বাহির হইতে চাহিল। কী হইয়াছে? কেন সে বিনয়বাবুকে বার বার এমন করিয়া খোঁচা দিতেছে এবং নিজে ব্যথা পাইতেছে?

বিনয় যতক্ষণ অভিনয়ে যোগ দিতে নারাজ ছিল ললিতার জেদও ততক্ষণ কেবলই চড়িয়া উঠিতেছিল। কিন্তু যখনই সে রাজি হইল তখনই তাহার সমস্ত উৎসাহ চলিয়া গেল। যোগ না-দিবার পক্ষে যতগুলি তর্ক, সমস্ত তাহার মনে প্রবল হইয়া উঠিল। তখন তাহার মন পীড়িত হইয়া বলিতে লাগিল, ‘কেবল আমার অনুরোধ রাখিবার জন্য বিনয়বাবুর এমন করিয়া রাজি হওয়া উচিত হয় নাই। অনুরোধ! কেন অনুরোধ রাখিবেন? তিনি মনে করেন, অনুরোধ রাখিয়া তিনি আমার সঙ্গে ভদ্রতা করিতেছেন। তাঁহার এই ভদ্রতাটুকু পাইবার জন্য আমার যেন অত্যন্ত মাথাব্যথা!’

কিন্তু এখন অমন করিয়া স্পর্ধা করিলে চলিবে কেন? সত্যই যে সে বিনয়কে অভিনয়ের দলে টানিবার জন্য ক্রমাগত নির্বন্ধ প্রকাশ করিয়াছে। বিনয় ভদ্রতার দায়ে তাহার এত জেদের অনুরোধ রাখিয়াছে বলিয়া রাগ করিলেই বা চলিবে কেন? এই ঘটনায় ললিতার নিজের উপরে এমনই তীব্র ঘৃণা ও লজ্জা উপস্থিত হইল যে স্বভাবত এতটা হইবার কোনো কারণ ছিল না। অন্যদিন হইলে তাহার মনের চাঞ্চল্যের সময় সে সুচরিতার কাছে যাইত। আজ গেল না এবং কেন যে তাহার বুকটাকে ঠেলিয়া তুলিয়া তাহার চোখ দিয়া এমন করিয়া জল বাহির হইতে লাগিল তাহা সে নিজেই ভালো করিয়া বুঝিতে পারিল না।