গোরা
করিয়াই দেখিয়াছিল। কিন্তু অঙ্কুশাহত হাতি যেমন তাহার মাহুতকে ভুলিবার সময় পায় না, কিছুদিন হইতে ললিতা সম্বন্ধে বিনয়ের সেই দশা হইয়াছিল। কী করিয়া ললিতাকে একটুখানি প্রসন্ন করিবে এবং শান্তি পাইবে বিনয়ের এই চিন্তাই প্রধান হইয়া উঠিয়াছিল। সন্ধ্যার সময় বাসায় আসিয়া ললিতার তীব্রহাস্যদিগ্ধ জ্বালাময় কথাগুলি একটার পর একটা কেবলই তাহার মনে বাজিয়া উঠিত এবং তাহার নিদ্রা দূর করিয়া রাখিত। ‘আমি গোরার ছায়ার মতো, আমার নিজের কোনো পদার্থ নাই, ললিতা এই বলিয়া অবজ্ঞা করেন, কিন্তু কথাটা সম্পূর্ণ অসত্য।’ ইহার বিরুদ্ধে নানাপ্রকার যুক্তি সে মনের মধ্যে জড়ো করিয়া তুলিত। কিন্তু এ-সমস্ত যুক্তি তাহার কোনো কাজে লাগিত না। কারণ, ললিতা তো স্পষ্ট করিয়া এ অভিযোগ তাহার বিরুদ্ধে আনে নাই— এ কথা লইয়া তর্ক করিবার অবকাশই তাহাকে দেয় নাই। বিনয়ের জবাব দিবার এত কথা ছিল, তবু সেগুলো ব্যবহার করিতে না পারিয়া তাহার মনে ক্ষোভ আরো বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে কাল রাত্রে হারিয়াও যখন ললিতার মুখ সে প্রসন্ন দেখিল না তখন বাড়িতে আসিয়া সে নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িল। মনে মনে ভাবিতে লাগিল, সত্যই কি আমি এতই অবজ্ঞার পাত্র?

এইজন্যই সতীশের কাছে যখন সে শুনিল যে, ললিতাই তাহাকে গোলাপ ফুল দুটি সতীশের হাত দিয়া পাঠাইয়া দিয়াছে তখন সে অত্যন্ত একটা উল্লাস বোধ করিল। সে ভাবিল, অভিনয়ে যোগ দিতে রাজি হওয়াতেই সন্ধির নিদর্শনস্বরূপ ললিতা তাহাকে খুশি হইয়া এই গোলাপ দুটি দিয়াছে। প্রথমে মনে করিল ‘ফুল দুটি বাড়িতে রাখিয়া আসি’; তাহার পরে ভাবিল, ‘না, এই শান্তির ফুল মায়ের পায়ে দিয়া ইহাকে পবিত্র করিয়া আনি।’

সেদিন বিকালে বিনয় যখন পরেশবাবুর বাড়িতে গেল তখন সতীশ ললিতার কাছে তাহার ইস্কুলের পড়া বলিয়া লইতেছে। বিনয় ললিতাকে কহিল, “যুদ্ধেরই রঙ লাল, অতএব সন্ধির ফুল সাদা হওয়া উচিত ছিল।”

ললিতা কথাটা বুঝিতে না পারিয়া বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল। বিনয় তখন একটি গুচ্ছ শ্বেতকরবী চাদরের মধ্য হইতে বাহির করিয়া ললিতার সম্মুখে ধরিয়া কহিল, “আপনার ফুল দুটি যতই সুন্দর হোক, তবু তাতে ক্রোধের রঙটুকু আছে। আমার এ ফুল সৌন্দর্যে তার কাছে দাঁড়াতে পারে না, কিন্তু শান্তির শুভ্র রঙের নম্রতা স্বীকার করে আপনার কাছে হাজির হয়েছে।”

ললিতা কর্ণমূল রাঙা করিয়া কহিল, “আমার ফুল আপনি কাকে বলছেন?”

বিনয় কিছু অপ্রতিভ হইয়া কহিল, “তবে তো ভুল বুঝেছি। সতীশবাবু, কার ফুল কাকে দিলে?”

সতীশ উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “বাঃ, ললিতাদিদি যে দিতে বললে!”

বিনয়। কাকে দিতে বললেন?

সতীশ। আপনাকে।

ললিতা রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়া সতীশের পিঠে এক চাপড় মারিয়া কহিল, “তোর মতো বোকা তো আমি দেখি নি। বিনয়বাবুর ছবির বদলে তুই তাঁকে ফুল দিতে চাইলি নে?”

সতীশ হতবুদ্ধি হইয়া কহিল, “হাঁ, তাই তো, কিন্তু তুমিই আমাকে দিতে বললে না?”

সতীশের সঙ্গে তকরার করিতে গিয়া ললিতা আরো বেশি করিয়া জালে জড়াইয়া পড়িল। বিনয় স্পষ্ট বুঝিল ফুল দুটি ললিতাই দিয়াছে, কিন্তু বেনামিতেই কাজ করা তাহার অভিপ্রায় ছিল। বিনয় কহিল, “আপনার ফুলের দাবি আমি ছেড়েই দিচ্ছি, কিন্তু তাই বলে আমার এই ফুলের মধ্যে ভুল কিছুই নেই। আমাদের বিবাদনিষ্পত্তির শুভ উপলক্ষে এই ফুল কয়টি— ”

ললিতা মাথা নাড়িয়া কহিল, “আমাদের বিবাদই বা কী, আর তার নিষ্পত্তিই বা কিসের?”

বিনয় কহিল, “একেবারে আগাগোড়া সমস্তই মায়া? বিবাদও ভুল, ফুলও তাই, নিষ্পত্তিও মিথ্যা? শুধু শুক্তিতে রজতভ্রম নয়, শুক্তিটা-সুদ্ধই ভ্রম? ঐ-যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে অভিনয়ের একটা কথা হচ্ছিল সেটা— ”