গোরা
তাঁহার মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় হস্তক্ষেপ করিতেন না। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাঁহারা প্রতিশ্রুত হইয়াছেন, সেই অনুসারে সে পক্ষও আয়োজন করিয়াছেন, সময় অত্যন্ত সংকীর্ণ, এই-সমস্ত বিবেচনা করিয়া পরেশবাবু ললিতাকে ডাকিয়া তাহার মাথায় হাত দিয়া কহিলেন, “ললিতা, এখন তুমি ছেড়ে দিলে যে অন্যায় হবে।”

ললিতা রুদ্ধরোদন কণ্ঠে কহিল, “বাবা, আমি যে পারি নে। আমার হয় না।”

‍পরেশ কহিলেন, “তুমি ভালো না পারলে তোমার অপরাধ হবে না, কিন্তু না করলে অন্যায় হবে।”

ললিতা মুখ নিচু করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল; পরেশবাবু কহিলেন, “মা, যখন তুমি ভার নিয়েছ তখন তোমাকে তো সম্পন্ন করতেই হবে। পাছে অহংকারে ঘা লাগে বলে আর তো পালাবার সময় নেই। লাগুক-না ঘা, সেটাকে অগ্রাহ্য করেও তোমাকে কর্তব্য করতে হবে। পারবে না মা?”

ললিতা পিতার মুখের দিকে মুখ তুলিয়া কহিল, “পারব।”

সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় বিশেষ করিয়া বিনয়ের সম্মুখেই সমস্ত সংকোচ সম্পূর্ণ দূর করিয়া সে যেন একটা অতিরিক্ত বলের সঙ্গে, যেন স্পর্ধা করিয়া নিজের কর্তব্যে প্রবৃত্ত হইল। বিনয় এতদিন তাহার আবৃত্তি শোনে নাই। আজ শুনিয়া আশ্চর্য হইল। এমন সুস্পষ্ট সতেজ উচ্চারণ, কোথাও কিছুমাত্র জড়িমা নাই, এবং ভাব-প্রকাশের মধ্যে এমন একটা নিঃসংশয় বল যে, শুনিয়া বিনয় প্রত্যাশাতীত আনন্দ লাভ করিল। এই কণ্ঠস্বর তাহার কানে অনেকক্ষণ ধরিয়া বাজিতে লাগিল।

কবিতা-আবৃত্তিতে ভালো আবৃত্তিকারকের সম্বন্ধে শ্রোতার মনে একটা বিশেষ মোহ উৎপন্ন করে। সেই কবিতার ভাবটি তাহার পাঠককে মহিমা দান করে— সেটা যেন তাহার কণ্ঠস্বর, তাহার মুখশ্রী, তাহার চরিত্রের সঙ্গে জড়িত হইয়া দেখা দেয়। ফুল যেমন গাছের শাখায় তেমনি কবিতাটিও আবৃত্তিকারকের মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়া তাহাকে বিশেষ সম্পদ দান করে।

ললিতাও বিনয়ের কাছে কবিতায় মণ্ডিত হইয়া উঠিতে লাগিল। ললিতা এতদিন তাহার তীব্রতার দ্বারা বিনয়কে অনবরত উত্তেজিত করিয়া রাখিয়াছিল। যেখানে ব্যথা সেইখানেই কেবলই যেমন হাত পড়ে, বিনয়ও তেমনি কয়দিন ললিতার উষ্ণ বাক্য এবং তীক্ষ্ণ হাস্য ছাড়া আর কিছু ভাবিতেই পারে নাই। কেন যে ললিতা এমন করিল, তেমন বলিল, ইহাই তাহাকে বারংবার আলোচনা করিতে হইয়াছে; ললিতার অসন্তোষের রহস্য যতই সে ভেদ করিতে না পারিয়াছে ততই ললিতার চিন্তা তাহার মনকে অধিকার করিয়াছে। হঠাৎ ভোরের বেলা ঘুম হইতে জাগিয়া সে কথা তাহার মনে পড়িয়াছে, পরেশবাবুর বাড়িতে আসিবার সময় প্রত্যহই তাহার মনে বিতর্ক উপস্থিত হইয়াছে আজ না জানি ললিতাকে কিরূপভাবে দেখা যাইবে। যেদিন ললিতা লেশমাত্র প্রসন্নতা প্রকাশ করিয়াছে সেদিন বিনয় যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছে এবং এই ভাবটি কী করিলে স্থায়ী হয় সেই চিন্তাই করিয়াছে, কিন্তু এমন কোনো উপায় খুঁজিয়া পায় নাই যাহা তাহার আয়ত্তাধীন।

এ কয়দিনের এই মানসিক আলোড়নের পর ললিতার কাব্য-আবৃত্তির মাধুর্য বিনয়কে বিশেষ করিয়া এবং প্রবল করিয়া বিচলিত করিল। তাহার এত ভালো লাগিল যে, কী বলিয়া প্রশংসা করিবে ভাবিয়া পাইল না। ললিতার মুখের সামনে ভালোমন্দ কোনো কথাই বলিতে তাহার সাহস হয় না— কেননা তাহাকে ভালো বলিলেই যে সে খুশি হইবে, মনুষ্যচরিত্রের এই সাধারণ নিয়ম ললিতার সম্বন্ধে না খাটিতে পারে— এমন-কি, সাধারণ নিয়ম বলিয়াই হয়তো খাটিবে না— এই কারণে বিনয় উচ্ছ্বসিত হৃদয় লইয়া বরদাসুন্দরীর নিকট ললিতার ক্ষমতার অজস্র প্রশংসা করিল। ইহাতে বিনয়ের বিদ্যা ও বুদ্ধির প্রতি বরদাসুন্দরীর শ্রদ্ধা আরো দৃঢ় হইল।

আর-একটি আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেল। ললিতা যখনই নিজে অনুভব করিল তাহার আবৃত্তি ও অভিনয় অনিন্দনীয় হইয়াছে, সুগঠিত নৌকা ঢেউয়ের উপর দিয়া যেমন করিয়া চলিয়া যায় সেও যখন তেমনি সুন্দর করিয়া তাহার কর্তব্যের দুরূহতার উপর দিয়া