গোরা

ললিতা কহিল, “মাকে আমি বলব, কিন্তু সুচিদিদিকে রাজি করাবার ভার তোমাকে নিতে হবে।”

পরেশবাবু যখন বলিলেন তখন সুচরিতা আর আপত্তি করিতে পারিল না— সে আপন কর্তব্য পালন করিতে অগ্রসর হইল।

সুচরিতা কোণ হইতে বাহির হইয়া আসিতেই বিনয় তাহার সহিত পূর্বের ন্যায় আলাপ জমাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু এই কয়দিনে কী একটা হইয়াছে, ভালো করিয়া সুচরিতার যেন নাগাল পাইল না। তাহার মুখশ্রীতে, তাহার দৃষ্টিপাতে, এমন একটা সুদূরত্ব প্রকাশ পাইতেছে যে, তাহার কাছে অগ্রসর হইতে সংকোচ উপস্থিত হয়। পূর্বেও মেলামেশা ও কাজকর্মের মধ্যে সুচরিতার একটা নির্লিপ্ততা ছিল, এখন সেইটে অত্যন্ত পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। সে যে অভিনয়-কার্যের অভ্যাসে যোগ দিয়াছিল তাহার মধ্যেও তাহার স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয় নাই। কাজের জন্য তাহাকে যতটুকু দরকার সেইটুকু সারিয়াই সে চলিয়া যাইত। সুচরিতার এইরূপ দূরত্ব প্রথমে বিনয়কে অত্যন্ত আঘাত দিল। বিনয় মিশুক লোক, যাহাদের সঙ্গে তাহার সৌহৃদ্য তাহাদের নিকট হইতে কোনোপ্রকার বাধা পাইলে বিনয়ের পক্ষে তাহা অত্যন্ত কঠিন হয়। এই পরিবারে সুচরিতার নিকট হইতেই এতদিন সে বিশেষভাবে সমাদর লাভ করিয়া আসিয়াছে, এখন হঠাৎ বিনা কারণে প্রতিহত হইয়া বড়োই বেদনা পাইল। কিন্তু যখন বুঝিতে পারিল এই একই কারণে সুচরিতার প্রতি ললিতার মনেও অভিমানের উদয় হইয়াছে তখন বিনয় সান্ত্বনালাভ করিল এবং ললিতার সহিত তাহার সম্বন্ধ আরো ঘনিষ্ঠ হইল। তাহার নিকট হইতে সুচরিতাকে এড়াইয়া চলিবার অবকাশও সে দিল না, সে আপনিই সুচরিতার নিকট-সংস্রব পরিত্যাগ করিল এবং এমনি করিয়া দেখিতে দেখিতে সুচরিতা বিনয়ের নিকট হইতে বহুদূরে চলিয়া গেল।

এবারে কয়দিন গোরা উপস্থিত না থাকাতে বিনয় অত্যন্ত অবাধে পরেশবাবুর পরিবারের সঙ্গে সকল রকম করিয়া মিশিয়া যাইতে পারিয়াছিল। বিনয়ের স্বভাব এইরূপ অবারিতভাবে প্রকাশ পাওয়াতে পরেশবাবুর বাড়ির সকলেই একটা বিশেষ তৃপ্তি অনুভব করিল। বিনয়ও নিজের এইরূপ বাধামুক্ত স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করিয়া যেরূপ আনন্দ পাইল এমন আর কখনো পায় নাই। তাহাকে যে ইঁহাদের সকলেরই ভালো লাগিতেছে ইহাই অনুভব করিয়া তাহার ভালো লাগাইবার শক্তি আরো বাড়িয়া উঠিল।

প্রকৃতির এই প্রসারণের সময়ে, নিজেকে স্বতন্ত্র শক্তিতে অনুভব করিবার দিনে, বিনয়ের কাছ হইতে সুচরিতা দূরে চলিয়া গেল। এই ক্ষতি এই আঘাত অন্য সময় হইলে দুঃসহ হইত, কিন্তু এখন সেটা সে সহজেই উত্তীর্ণ হইয়া গেল। আশ্চর্য এই যে, ললিতাও সুচরিতার ভাবান্তর উপলক্ষ করিয়া তাহার প্রতি পূর্বের ন্যায় অভিমান প্রকাশ করে নাই। আবৃত্তি ও অভিনয়ের উৎসাহই কি তাহাকে সম্পূর্ণ অধিকার করিয়াছিল?

এ দিকে সুচরিতাকে অভিনয়ে যোগ দিতে দেখিয়া হঠাৎ হারানবাবুও উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন। তিনি ‘প্যারাডাইস লস্ট্‌’ হইতে এক অংশ আবৃত্তি করিবেন এবং ড্রাইডেনের কাব্য-আবৃত্তির ভূমিকাস্বরূপে সংগীতের মোহিনী শক্তি সম্বন্ধে একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা করিবেন বলিয়া স্বয়ং প্রস্তাব করিলেন। ইহাতে বরদাসুন্দরী মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন, ললিতাও সন্তুষ্ট হইল না। হারানবাবু নিজে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করিয়া এই প্রস্তাব পূর্বেই পাকা করিয়া আসিয়াছিলেন। ললিতা যখন বলিল ব্যাপারটাকে এত সুদীর্ঘ করিয়া তুলিলে ম্যাজিস্ট্রেট হয়তো আপত্তি করিবেন তখন হারানবাবু পকেট হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক পত্র বাহির করিয়া ললিতার হাতে দিয়া তাকে নিরুত্তর করিয়া দিলেন।

গোরা বিনা কাজে ভ্রমণে বাহির হইয়াছে, কবে ফিরিবে তাহা কেহ জানিত না। যদিও সুচরিতা এ সম্বন্ধে কোনো কথা মনে স্থান দিবে না ভাবিয়াছিল তবু প্রতিদিনই তাহার মনের ভিতরে আশা জন্মিত যে আজ হয়তো গোরা আসিবে। এ আশা কিছুতেই সে মন হইতে দমন করিতে পারিত না। গোরার ঔদাসীন্য এবং নিজের মনের এই অবাধ্যতায় যখন সে নিরতিশয় পীড়া বোধ করিতেছিল, যখন কোনোমতে এই জাল ছিন্ন করিয়া পলায়ন করিবার জন্য তাহার চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল, এমন সময় হারানবাবু একদিন বিশেষভাবে ঈশ্বরের নাম করিয়া সুচরিতার সহিত তাহার সম্বন্ধ পাকা করিবার জন্য পরেশবাবুকে পুনর্বার অনুরোধ