গোরা
রাজত্ব যে ঈশ্বরের বিধান— এই অকৃতজ্ঞরা এখনো তাহা স্বীকার করিতে চাহিতেছে না। তাহার একমাত্র কারণ, ইহারা কেবল পড়া মুখস্থ করিয়াছে, কিন্তু ইহাদের ধর্মবোধ নিতান্তই অপরিণত।”

ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “খৃস্টকে স্বীকার না করিলে ভারতবর্ষে এই ধর্মবোধ কখনোই পূর্ণতা লাভ করিবে না।”

হারানবাবু কহিলেন, “সে এক হিসাবে সত্য।” এই বলিয়া খৃস্টকে স্বীকার করা সম্বন্ধে একজন খৃস্টানের সঙ্গে হারানবাবুর মতের কোন্‌ অংশে কতটুকু ঐক্য এবং কোথায় অনৈক্য তাহাই লইয়া হারানবাবু ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত সূক্ষ্মভাবে আলাপ করিয়া তাঁহাকে এই কথাপ্রসঙ্গে এতই নিবিষ্ট করিয়া রাখিয়াছিলেন যে, মেমসাহেব যখন পরেশবাবুর মেয়েদিগকে গাড়ি করিয়া ডাকবাংলায় পৌঁছাইয়া দিয়া ফিরিবার পথে তাঁহার স্বামীকে কহিলেন, “হ্যারি, ঘরে ফিরিতে হইবে”, তিনি চমকিয়া উঠিয়া ঘড়ি খুলিয়া কহিলেন, “বাই জোভ, আটটা বাজিয়া কুড়ি মিনিট।”

গাড়িতে উঠিবার সময় হারানবাবুর কর নিপীড়ন করিয়া বিদায়সম্ভাষণপূর্বক কহিলেন, “আপনার সহিত আলাপ করিয়া আমার সন্ধ্যা খুব সুখে কাটিয়াছে।”

হারানবাবু ডাকবাংলায় ফিরিয়া আসিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত তাঁহার আলাপের বিবরণ বিস্তারিত করিয়া বলিলেন। কিন্তু গোরার সহিত সাক্ষাতের কোনো উল্লেখমাত্র করিলেন না।

২৮

কোনোপ্রকার অপরাধ বিচার না করিয়া কেবলমাত্র গ্রামকে শাসন করিবার জন্য সাতচল্লিশ জন আসামিকে হাজতে দেওয়া হইয়াছে।

ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত সাক্ষাতের পর গোরা উকিলের সন্ধানে বাহির হইল। কোনো লোকের কাছে খবর পাইল, সাতকড়ি হালদার এখানকার একজন ভালো উকিল। সাতকড়ির বাড়ি যাইতেই সে বলিয়া উঠিল, “বাঃ, গোরা যে! তুমি এখানে!”

গোরা যা মনে করিয়াছিল তাই বটে— সাতকড়ি গোরার সহপাঠী। গোরা কহিল, চর-ঘোষপুরের আসামিদিগকে জামিনে খালাস করিয়া তাহাদের মকদ্দমা চালাইতে হইবে।

সাতকড়ি কহিল, “জামিন হবে কে?”

গোরা কহিল, “আমি হব।”

সাতকড়ি কহিল, “তুমি সাতচল্লিশ জনের জামিন হবে তোমার এমন কী সাধ্য আছে?”

গোরা কহিল, “যদি মোক্তাররা মিলে জামিন হয় তার ফী আমি দেব।”

সাতকড়ি কহিল, “টাকা কম লাগবে না।”

পরদিন ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে জামিন-খালাসের দরখাস্ত হইল। ম্যাজিস্ট্রেট গতকল্যকার সেই মলিনবস্ত্রধারী পাগড়ি-পরা বীরমূর্তির দিকে একবার কটাক্ষ নিক্ষেপ করিলেন এবং দরখাস্ত অগ্রাহ্য করিয়া দিলেন। চৌদ্দ বৎসরের ছেলে হইতে আশি বৎসরের বুড়া পর্যন্ত হাজতে পচিতে লাগিল।

গোরা ইহাদের হইয়া লড়িবার জন্য সাতকড়িকে অনুরোধ করিল। সাতকড়ি কহিল, “সাক্ষী পাবে কোথায়? যারা সাক্ষী হতে পারত তারা সবাই আসামি। তার পরে এই সাহেব-মারা মামলার তদন্তের চোটে এ অঞ্চলের লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ম্যাজিস্ট্রেটের ধারণা হয়েছে ভিতরে ভিতরে ভদ্রলোকের যোগ আছে; হয়তো বা আমাকেও সন্দেহ করে, বলা যায় না। ইংরেজি