গোরা

বিনয় জানিত গোরাকে টলানো সম্ভব নয়— অতএব উকিল রাখার চেষ্টা ছাড়িয়া দিতে হইল। বলিল, “তুমি তো খেতে এখানে পারবে না জানি, বাইরে থেকে কিছু খাবার পাঠাবার জোগাড় করে দিই।”

গোরা অধীর হইয়া কহিল, “বিনয়, কেন তুমি বৃথা চেষ্টা করছ। বাইরে থেকে আমি কিছুই চাই নে। হাজতে সকলের ভাগ্যে যা জোটে আমি তার চেয়ে কিছু বেশি চাই নে।”

বিনয় ব্যথিত চিত্তে ডাকবাংলায় ফিরিয়া আসিল। সুচরিতা রাস্তার দিকের একটা শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া জানালা খুলিয়া বিনয়ের প্রত্যাবর্তন প্রতীক্ষা করিয়া ছিল। কোনোমতেই অন্য সকলের সঙ্গ এবং আলাপ সে সহ্য করিতে পারিতেছিল না।

সুচরিতা যখন দেখিল বিনয় চিন্তিত বিমর্ষমুখে ডাকবাংলার অভিমুখে আসিতেছে তখন আশঙ্কায় তাহার বুকের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে লাগিল। বহু চেষ্টায় সে নিজেকে শান্ত করিয়া একটা বই হাতে করিয়া বসিবার ঘরে আসিল। ললিতা সেলাই ভালোবাসে না, কিন্তু সে আজ চুপ করিয়া কোণে বসিয়া সেলাই করিতেছিল— লাবণ্য সুধীরকে লইয়া ইংরেজি বানানের খেলা খেলিতেছিল, লীলা ছিল দর্শক; হারানবাবু বরদাসুন্দরীর সঙ্গে আগামী কল্যকার উৎসবের কথা আলোচনা করিতেছিলেন।

আজ প্রাতঃকালে পুলিসের সঙ্গে গোরার বিরোধের ইতিহাস বিনয় সমস্ত বিবৃত করিয়া বলিল। সুচরিতা স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল, ললিতার কোল হইতে সেলাই পড়িয়া গেল এবং মুখ লাল হইয়া উঠিল।

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “আপনি কিছু ভাববেন না বিনয়বাবু— আজ সন্ধ্যাবেলায় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মেমের কাছে গৌরমোহনবাবুর জন্যে আমি নিজে অনুরোধ করব।”

বিনয় কহিল, “না, আপনি তা করবেন না— গোরা যদি শুনতে পায় তা হলে জীবনে সে আমাকে আর ক্ষমা করবে না।”

সুধীর কহিল, “তাঁর ডিফেন্সের জন্যে তো কোনো বন্দোবস্ত করতে হবে।”

জামিন দিয়া খালাসের চেষ্টা এবং উকিল নিয়োগ সম্বন্ধে গোরা যে-সকল আপত্তি করিয়াছিল বিনয় তাহা সমস্তই বলিল— শুনিয়া হারানবাবু অসহিষ্ণু হইয়া কহিলেন, “এ-সমস্ত বাড়াবাড়ি!”

হারানবাবুর প্রতি ললিতার মনের ভাব যাই থাক্‌, সে এপর্যন্ত তাঁহাকে মান্য করিয়া আসিয়াছে, কখনো তাঁহার সঙ্গে তর্কে যোগ দেয় নাই— আজ সে তীব্রভাবে মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, “কিছুমাত্র বাড়াবাড়ি নয়— গৌরবাবু যা করেছেন সে ঠিক করেছেন— ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের জব্দ করবে আর আমরা নিজেরা নিজেকে রক্ষা করব! তাদের মোটা মাইনে জোগাবার জন্যে ট্যাক্স জোগাতে হবে, আবার তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে উকিল-ফী গাঁট থেকে দিতে হবে! এমন বিচার পাওয়ার চেয়ে জেলে যাওয়া ভালো।”

ললিতাকে হারানবাবু এতটুকু দেখিয়াছেন— তাহার যে একটা মতামত আছে সে কথা তিনি কোনোদিন কল্পনাও করেন নাই। সেই ললিতার মুখের তীব্র ভাষা শুনিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন; তাহাকে ভ‍র্ৎসনার স্বরে কহিলেন, “তুমি এ-সব কথার কী বোঝ? যারা গোটাকতক বই মুখস্থ করে পাস করে সবে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে, যাদের কোনো ধর্ম নেই, ধারণা নেই, তাদের মুখ থেকে দায়িত্বহীন উন্মত্ত প্রলাপ শুনে তোমাদের মাথা ঘুরে যায়!”

এই বলিয়া গতকল্য সন্ধ্যার সময় গোরার সহিত ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষাৎ-বিবরণ এবং সে সম্বন্ধে তাঁহার নিজের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের আলাপের কথা বিবৃত করিলেন। চর-ঘোষপুরের ব্যাপার বিনয়ের জানা ছিল না। শুনিয়া সে শঙ্কিত হইয়া উঠিল; বুঝিল, ম্যাজিস্ট্রেট গোরাকে সহজে ক্ষমা করিবে না।

হারান যে উদ্দেশ্যে এই গল্পটা বলিলেন তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়া গেল। তিনি যে গোরার সহিত তাঁহার দেখা হওয়া সম্বন্ধে এতক্ষণ পর্যন্ত একেবারে নীরব ছিলেন তাহার ভিতরকার ক্ষুদ্রতা সুচরিতাকে আঘাত করিল এবং হারানবাবুর প্রত্যেক কথার মধ্যে