গোরা

বিনয় অত্যন্ত অসম্ভব ও অসংগত নাম করিতে লাগিল— কখনো বলিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা, কখনো বলিল রাজা নবকৃষ্ণ, একবার নন্দকুমারেরও নাম করিল। এরূপ অতিথিসমাগম যে একেবারেই অসম্ভব সতীশ তাহারই অকাট্য কারণ দেখাইয়া উচৈঃস্বরে প্রতিবাদ করিল। বিনয় হার মানিয়া নম্রস্বরে কহিল, “তা বটে, সিরাজউদ্দৌলার যে এ বাড়িতে আসার কতকগুলো গুরুতর অসুবিধা আছে সে কথা আমি এপর্যন্ত চিন্তা করে দেখি নি। যা হোক, তোমার দিদি তো আগে তদন্ত করে আসুন, তার পরে যদি প্রয়োজন হয় আমাকে ডাক দিলেই আমি যাব।”

সতীশ কহিল, “না, আপনারা দুজনেই আসুন।”

ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কোন্‌ ঘরে যেতে হবে?”

সতীশ কহিল, “তেতালার ঘরে।”

তেতালার ছাদের কোণে একটি ছোটো ঘর আছে, তাহার দক্ষিণের দিকে রৌদ্র-বৃষ্টি-নিবারণের জন্য একটি ঢালু টালির ছাদ। সতীশের অনুবর্তী দুইজনে সেখানে গিয়া দেখিল ছোটো একটি আসন পাতিয়া সেই ছাদের নীচে একজন প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক চোখে চশমা দিয়া কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়িতেছেন। তাঁহার চশমার এক দিককার ভাঙা দণ্ডে দড়ি বাঁধা, সেই দড়ি তাঁহার কানে জড়ানো। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি হইবে। মাথার সামনের দিকে চুল বিরল হইয়া আসিয়াছে, কিন্তু গৌরবর্ণ মুখ পরিপক্ক ফলটির মতো এখনো প্রায় নিটোল রহিয়াছে; দুই ভ্রূর মাঝে একটি উল্‌‍কির দাগ— গায়ে অলংকার নাই, বিধবার বেশ। প্রথমে ললিতার দিকে চোখ পড়িতেই তাড়াতাড়ি চশমা খুলিয়া বই ফেলিয়া রাখিয়া, বিশেষ একটা ঔৎসুক্যের সহিত তাহার মুখের দিকে চাহিলেন; পরক্ষণেই তাহার পশ্চাতে বিনয়কে দেখিয়া দ্রুত উঠিয়া দাঁড়াইয়া মাথায় কাপড় টানিয়া দিলেন এবং ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিবার উপক্রম করিলেন। সতীশ তাড়াতাড়ি গিয়া তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “মাসিমা, পালাচ্ছ কেন? এই আমাদের ললিতাদিদি, আর ইনি বিনয়বাবু। বড়দিদি কাল আসবেন।”

বিনয়বাবুর এই অতিসংক্ষিপ্ত পরিচয়ই যথেষ্ট হইল; ইতিপূর্বেই বিনয়বাবু সম্বন্ধে আলোচনা যে প্রচুর পরিমাণে হইয়া গিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। পৃথিবীতে সতীশের যে-কয়টি বলিবার বিষয় জমিয়াছে কোনো উপলক্ষ পাইলেই তাহা সতীশ বলে এবং হাতে রাখিয়া বলে না।

মাসিমা বলিতে যে এখানে কাহাকে বুঝায় তাহা না বুঝিতে পারিয়া ললিতা অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বিনয় এই প্রৌঢ়া রমণীকে প্রণাম করিয়া তাহার পায়ের ধুলা লইতেই ললিতা তাহার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিল। মাসিমা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে একটি মাদুর বাহির করিয়া পাতিয়া দিলেন এবং কহিলেন, “বাবা বোসো, মা বোসো।”

বিনয় ও ললিতা বসিলে পর তিনি তাঁহার আসনে বসিলেন এবং সতীশ তাঁহার গা ঘেঁষিয়া বসিল। তিনি সতীশকে ডান হাত দিয়া নিবিড়ভাবে বেষ্টন করিয়া ধরিয়া কহিলেন, “আমাকে তোমরা জান না, আমি সতীশের মাসি হই— সতীশের মা আমার আপন দিদি ছিলেন।”

এইটুকু পরিচয়ের মধ্যে বেশি কিছু কথা ছিল না কিন্তু মাসিমার মুখে ও কণ্ঠস্বরে এমন একটি কী ছিল যাহাতে তাঁহার জীবনের সুগভীর শোকের অশ্রুমার্জিত পবিত্র একটি আভাস প্রকাশিত হইয়া পড়িল। ‘আমি সতীশের মাসি হই’ বলিয়া তিনি যখন সতীশকে বুকের কাছে চাপিয়া ধরিলেন তখন এই রমণীর জীবনের ইতিহাস কিছুই না জানিয়াও বিনয়ের মন করুণায় ব্যথিত হইয়া উঠিল। বিনয় বলিয়া উঠিল, “একলা সতীশের মাসিমা হলে চলবে না; তা হলে এতদিন পরে সতীশের সঙ্গে আমার ঝগড়া হবে। একে তো সতীশ আমাকে বিনয়বাবু বলে, দাদা বলে না, তার পরে মাসিমা থেকে বঞ্চিত করবে সে তো কোনোমতেই উচিত হবে না।”