গোরা
কিন্তু ললিতার সঙ্গে স্টীমারে আসার কোনো প্রসঙ্গই উত্থাপন করিলেন না। অন্ধকার হইয়া আসিলে কহিলেন, “চলো, বিনয়, ঘরে চলো।”

বিনয় কহিল, “না, আমি এখন বাসায় যাব।”

পরেশবাবু তাহাকে দ্বিতীয় বার অনুরোধ করিলেন না। বিনয় একবার চকিতের মতো দোতলার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

উপর হইতে ললিতা বিনয়কে দেখিতে পাইয়াছিল। যখন পরেশবাবু একলা ঘরে ঢুকিলেন তখন ললিতা মনে করিল, বিনয় হয়তো আর-একটু পরেই আসিবে। আর-একটু পরেও বিনয় আসিল না। তখন টেবিলের উপরকার দুটো-একটা বই ও কাগজ-চাপা নাড়াচাড়া করিয়া ললিতা ঘর হইতে চলিয়া গেল। পরেশবাবু তাহাকে ফিরিয়া ডাকিলেন— তাহার বিষণ্ন মুখের দিকে স্নেহপূর্ণ দৃষ্টি স্থাপিত করিয়া কহিলেন, “ললিতা, আমাকে একটা ব্রহ্মসংগীত শোনাও।”

বলিয়া বাতিটা আড়াল করিয়া দিলেন।

৩৪

পরদিনে বরদাসুন্দরী এবং তাঁহাদের দলের বাকি সকলে আসিয়া পৌঁছিলেন। হারানবাবু ললিতা সম্বন্ধে তাঁহার বিরক্তি সংবরণ করিতে না পারিয়া বাসায় না গিয়া ইঁহাদের সঙ্গে একেবারে পরেশবাবুর কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বরদাসুন্দরী ক্রোধে ও অভিমানে ললিতার দিকে না তাকাইয়া এবং তাহার সঙ্গে কোনো কথা না কহিয়া একেবারে তাঁহার ঘরে গিয়া প্রবেশ করিলেন। লাবণ্য ও লীলাও ললিতার উপরে খুব রাগ করিয়া আসিয়াছিল। ললিতা এবং বিনয় চলিয়া আসাতে তাহাদের আবৃত্তি ও অভিনয় এমন অঙ্গহীন হইয়া পড়িয়াছিল যে, তাহাদের লজ্জার সীমা ছিল না। সুচরিতা হারানবাবুর ক্রুদ্ধ ও কটু উত্তেজনায়, বরদাসুন্দরীর অশ্রুমিশ্রিত আক্ষেপে, অথবা লাবণ্য-লীলার লজ্জিত নিরুৎসাহে কিছুমাত্র যোগ না দিয়া একেবারে নিস্তব্ধ হইয়া ছিল— তাহার নির্দিষ্ট কাজটুকু সে কলের মতো করিয়া গিয়াছিল। আজও সে যন্ত্রচালিতের মতো সকলের পশ্চাতে ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। সুধীর লজ্জায় এবং অনুতাপে সংকুচিত হইয়া পরেশবাবুর বাড়ির দরজার কাছ হইতেই বাসায় চলিয়া গেল— লাবণ্য তাহাকে বাড়িতে আসিবার জন্য বার বার অনুরোধ করিয়া কৃতকার্য না হইয়া তাহার প্রতি আড়ি করিল।

হারান পরেশবাবুর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই বলিয়া উঠিলেন, “একটা ভারি অন্যায় হয়ে গেছে।”

পাশের ঘরে ললিতা ছিল, তাহার কানে কথাটা প্রবেশ করিবামাত্র সে আসিয়া তাহার বাবার চৌকির পৃষ্ঠদেশে দুই হাত রাখিয়া দাঁড়াইল এবং হারানবাবুর মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল।

পরেশবাবু কহিলেন, “আমি ললিতার কাছ থেকে সমস্ত সংবাদ শুনেছি। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে এখন আলোচনা করে কোনো ফল নেই।”

হারান শান্ত সংযত পরেশকে নিতান্ত দুর্বলস্বভাব বলিয়া মনে করিতেন। তাই কিছু অবজ্ঞার ভাবে কহিলেন, “ঘটনা তো হয়ে চুকে যায়, কিন্তু চরিত্র যে থাকে, সেইজন্যেই যা হয়ে যায় তারও আলোচনার প্রয়োজন আছে। ললিতা আজ যে কাজটি করেছে তা কখনোই সম্ভব হত না যদি আপনার কাছে বরাবর প্রশ্রয় পেয়ে না আসত— আপনি ওর যে কতদূর অনিষ্ট করেছেন তা আজকের ব্যাপার সবটা শুনলে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন।”

পরেশবাবু পিছন দিকে তাঁহার চৌকির গাত্রে একটা ঈষৎ আন্দোলন অনুভব করিয়া তাড়াতাড়ি ললিতাকে তাঁহার পাশে টানিয়া