প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
পরিবারের মধ্যে ক্ষুদ্রতম সতীশকে নিজের গৌরব সপ্রমাণ করিবার জন্য এমনি করিয়া বারংবার গলার জোর প্রয়োগ করিতে হয়। আজ প্রমাণকে তাহার চেয়েও দৃঢ়তর করিবার জন্য সে তখনই বিনয়ের বাসায় ছুটিয়া গেল। ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “তিনি যে বাড়িতে নেই, তাই জন্যে আসতে পারেন নি।”
ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “এ কদিন আসেন নি কেন?”
সতীশ কহিল, “কদিনই যে ছিলেন না।”
তখন ললিতা সুচরিতার কাছে গিয়া কহিল, “দিদিভাই, গৌরবাবুর মায়ের কাছে আমাদের কিন্তু একবার যাওয়া উচিত।”
সুচরিতা কহিল, “তাঁদের সঙ্গে যে পরিচয় নেই।”
ললিতা কহিল, “বাঃ, গৌরবাবুর বাপ যে বাবার ছেলেবেলাকার বন্ধু ছিলেন।”
সুচরিতার মনে পড়িয়া গেল, কহিল, “হাঁ, তা বটে।”
সুচরিতাও অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া উঠিল। কহিল, “ললিতাভাই, তুমি যাও, বাবার কাছে বলো গে।”
ললিতা কহিল, “না, আমি বলতে পারব না, তুমি বলো গে।”
শেষকালে সুচরিতাই পরেশবাবুর কাছে গিয়া কথাটা পাড়িতেই তিনি বলিলেন, “ঠিক বটে, এতদিন আমাদের যাওয়া উচিত ছিল।”
আহারের পর যাওয়ার কথাটা যখনই স্থির হইয়া গেল তখনই ললিতার মন বাঁকিয়া উঠিল। তখন আবার কোথা হইতে অভিমান এবং সংশয় আসিয়া তাহাকে উলটা দিকে টানিতে লাগিল। সুচরিতাকে গিয়া সে কহিল, “দিদি, তুমি বাবার সঙ্গে যাও। আমি যাব না।”
সুচরিতা কহিল, “সে কি হয়! তুই না গেলে আমি একলা যেতে পারব না। লক্ষ্মী আমার, ভাই আমার— চল্ ভাই, গোল করিস নে।”
অনেক অনুনয়ে ললিতা গেল। কিন্তু বিনয়ের কাছে সে যে পরাস্ত হইয়াছে— বিনয় অনায়াসেই তাহাদের বাড়ি না আসিয়া পারিল, আর সে আজ বিনয়কে দেখিতে ছুটিয়াছে— এই পরাভবের অপমানে তাহার বিষম একটা রাগ হইতে লাগিল। বিনয়কে এখানে দেখিতে পাইবার আশাতেই আনন্দময়ীর বাড়ি আসিবার জন্য যে তাহার এতটা আগ্রহ জন্মিয়াছিল, এই কথাটা সে মনে মনে একেবারে অস্বীকার করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল এবং নিজের সেই জিদ বজায় রাখিবার জন্য না বিনয়ের দিকে তাকাইল, না তাহার নমস্কার ফিরাইয়া দিল, না তাহার সঙ্গে একটা কথা কহিল। বিনয় মনে করিল, ললিতার কাছে তাহার মনের গোপন কথাটা ধরা পড়িয়াছে বলিয়াই সে অবজ্ঞার দ্বারা তাহাকে এমন করিয়া প্রত্যাখ্যান করিতেছে। ললিতা যে তাহাকে ভালোবাসিতেও পারে, এ কথা অনুমান করিবার উপযুক্ত আত্মাভিমান বিনয়ের ছিল না।
বিনয় আসিয়া সংকোচে দরজার কাছে দাঁড়াইয়া কহিল, “পরেশবাবু এখন বাড়ি যেতে চাচ্ছেন, এঁদের সকলকে খবর দিতে বললেন।”
ললিতা যাহাতে তাহাকে না দেখিতে পায় এমন করিয়াই বিনয় দাঁড়াইয়াছিল।
আনন্দময়ী কহিলেন, “সে কি হয়! কিছু মিষ্টিমুখ না করে বুঝি যেতে পারেন! আর বেশি দেরি হবে না। তুমি এখানে একটু বোসো বিনয়, আমি একবার দেখে আসি। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন, ঘরের মধ্যে এসে বোসো।”
বিনয় ললিতার দিকে আড় করিয়া কোনোমতে দূরে এক জায়গায় বসিল। যেন বিনয়ের প্রতি তাহার ব্যবহারের কোনো বৈলক্ষণ্য হয় নাই এমনি সহজভাবে ললিতা কহিল, “বিনয়বাবু, আপনার বন্ধু সতীশকে আপনি একেবারে ত্যাগ করেছেন কি না