নলিনী

নীরজা। আমাকে অমন ক’রে তুমি ব’লো না – তোমার কথা শুনে আমার চোখে আরও জল আসে! আমি তোমার কি করতে পারি? আমি কি করলে তোমার একটুও শান্তি হয়? আমার কাছে অমন ক’রে চেয়ো না! আমার কি আছে,কি দেব,কিছু যেন ভেবে পাই নে।

নীরদ। (স্বগত ) এই মমতার কিছু অংশও যদি তার থাকত! এত কাল যে আমি ছায়ার মত তার কাছে কাছে ছিলুম, আমাকে ভাল নাই বাসুক, এতটুকু মায়াও কি আমার উপর জড়ায় নি, যে একখানি চিঠি লিখে আমাকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কেমন আছ? আজও সে তার বাগানে তেমনি করে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে? আমি চলে এসেছি বলে তার জগতের একটি তিলও শূন্য হয় নি? কেনই বা হবে? নিষ্ঠুর মমতাহীন জড়প্রকৃতির এই রকমই ত নিয়ম। আমি চলে এসেচি বলে কি তার বাগানে একটি বেল ফুলও কম ফুটবে? একটি পাখীও কম করে গাবে? কিন্তু তাই বলে কি রমণীর প্রাণও সেই রকম?

নীরজা। নীরদ, তোমার মনের দুঃখ আমার কাছে প্রকাশ করে কি তোমার একটুও শান্তি হয় না? আমাকে কি তুমি ততটুকুও ভালবাস না? তবে আজ কেন তুমি আমাকে কিছু বলচ না? কেন আপনার দুঃখ নিয়ে আপনি বসে আছ?

নীরদ। নীরজা, তুমি কি মনে করচ, আমি নলিনীকে ভালবেসে কষ্ট পাচ্চি? তা মনেও করো না। তাকে আমি ভালবাসব কি করে? তাতে আমাতে যে আকাশ পাতাল প্রভেদ।

নীরজা। কিন্তু, কেনই বা তাকে না ভালবাসবে? হয়ত সে ভালবাসাবার যোগ্য।

নীরদ। না নীরজা, আমি তাকে ভালবাসি নে। আমি তোমাকে বার বার করে বলচি, আমি তাকে ভালবাসি নে। এক কালে ভালবাসি বলে ভ্রম হয়েছিল। কিন্তু সে ভ্রম একেবারে গিয়েছে। কেনই বা আমি তাকে ভালবাসব? সে কি আমাকে মমতা করতে পারে? সে কি আমার প্রাণের কথা বুঝতে পারে? তার কি হৃদয় আছে? সে কেবল হাসতেই জানে, সে কি পরের জন্যে কখনও কেঁদেচে?

নীরজা। কিন্তু সত্যি কথা বলি নীরদ, তোমরা পুরুষ মানুষেরা আমাদের ঠিক বুঝতে পার না। তুমি হয়ত জান না তার প্রাণের মধ্যে কি আছে! হয়ত সে তোমাকে ভালবাসে।

নীরদ। তা হবে! হয়ত তার প্রাণের কথা আমি ঠিক জানি নে। কিন্তু এ প্রতারণায় তার আবশ্যক কি ছিল? যখন তার মুখে কেবলমাত্র একটি কথা শোনবার জন্য আমার সমস্ত প্রাণের আশা একেবারে উন্মুখ হয়েছিল, তখন সে কেন মুখ ফিরিয়ে অন্যমনস্কের মত ফুল কুড়োতে লাগল? আমার কথার কি একটি উত্তরও সে দিতে পারত না?

নীরজা। কেমন করে দেবে বল? ক্ষুদ্র বালিকা সে, সে কি ভাষা জানে যে তার প্রাণের সব কথা বলতে পারে? সে হয়ত ভাবলে, আমার মনের কথা আমি কিছুই ভাল করে বলতে পারব না, সেই জন্যই তুমি যদি আমার কথা ঠিক না বুঝতে পার, যদি দৈবাৎ আমার একটি কথাও আবিশ্বাস কর, তা হলে সে কি যন্ত্রণা! কি লজ্জা!

নীরদ। কিন্তু আমি কি তার ভাবেও কিছু বুঝতে পারতুম না!

নীরজা। তোমরা পুরুষরা যখন একবার নিজের হৃদয়ের কথা ভাব, তখন পরের হৃদয়ের দিকে একবার চেয়ে দেখতেও পার না। নিজের সুখ দুঃখের সঙ্গে যতটুকু যোগ সেইটুকুই দেখতে পাও, তার সুখ দুঃখ চোখে পড়েও না। সে যে কি ভাবে কথা কয় না, সে যে কি দুঃখে চলে যায়, তা তোমরা দেখ না—তোমরা কেবল ভাব আমার সঙ্গে কথা কইলে না, আমার কাছ থেকে চলে গেল।

নীরদ। তা হবে! আমরা স্বার্থপর, সেই জন্যেই আমরা অন্ধ। কিন্তু ও কথা আর কেন? ও-সব কথা আমি মন থেকে একেবারে তাড়িয়ে দিয়েছি। আর ত আমি তাকে ভালবাসি নে; ভালবাসতে পারিও না! তবে ও কথা থাক্। আর একটা কথা বলা