প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
পরেশবাবু তাঁহার মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, ক্ষুধাতুর হৃদয়ের বেদনায় তাহার সকরুণ দুটি চক্ষু যেন কাঙাল হইয়া এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছে। তিনি স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, “কেন পারবে না মা? কিন্তু তেমন মেয়ে-ইস্কুল কোথায়?”
যে সময়ের কথা হইতেছে তখন মেয়ে-ইস্কুল বেশি ছিল না, সামান্য পাঠশালা ছিল এবং ভদ্রঘরের মেয়েরা শিক্ষয়িত্রীর কাজে তখন অগ্রসর হন নাই। ললিতা ব্যাকুল হইয়া কহিল, “ইস্কুল নেই বাবা?”
পরেশবাবু কহিলেন, “কই, দেখি নে তো।”
ললিতা কহিল, “আচ্ছা, বাবা, মেয়ে-ইস্কুল কি একটা করা যায় না?”
পরেশবাবু কহিলেন, “অনেক খরচের কথা এবং অনেক লোকের সহায়তা চাই।”
ললিতা জানিত সৎকর্মের সংকল্প জাগাইয়া তোলাই কঠিন, কিন্তু তাহা সাধন করিবার পথেও যে এত বাধা তাহা সে পূর্বে ভাবে নাই। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া সে আস্তে আস্তে উঠিয়া চলিয়া গেল। তাঁহার এই প্রিয়তমা কন্যাটির হৃদয়ের ব্যথা কোন্খানে পরেশবাবু তাহাই বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। বিনয়ের সম্বন্ধে হারানবাবু সেদিন যে ইঙ্গিত করিয়া গিয়াছেন তাহাও তাঁহার মনে পড়িল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নিজেকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন—‘আমি কি অবিবেচনার কাজ করিয়াছি?’ তাঁহার অন্য কোনো মেয়ে হইলে বিশেষ চিন্তার কারণ ছিল না— কিন্তু ললিতার জীবন যে ললিতার পক্ষে অত্যন্ত সত্য পদার্থ, সে তো আধা-আধি কিছুই জানে না, সুখ-দুঃখ তাহার পক্ষে কিছু-সত্য কিছু-ফাঁকি নহে।
ললিতা প্রতিদিন নিজের জীবনের মধ্যে ব্যর্থ ধিক্কার বহন করিয়া বাঁচিয়া থাকিবে কেমন করিয়া? সে যে সম্মুখে কোথাও একটা প্রতিষ্ঠা, একটা মঙ্গল-পরিণাম দেখিতে পাইতেছে না। এমনভাবে নিরুপায় ভাসিয়া চলিয়া যাওয়া তাহার স্বভাবসিদ্ধ নহে।
সেইদিনই মধ্যাহ্নে ললিতা সুচরিতার বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। ঘরে গৃহসজ্জা বিশেষ কিছুই নাই। মেঝের উপর একটি ঘর-জোড়া শতরঞ্চ, তাহারই এক দিকে সুচরিতার বিছানা পাতা ও অন্য দিকে হরিমোহিনীর বিছানা। হরিমোহিনী খাটে শোন না বলিয়া সুচরিতাও তাঁহার সঙ্গে এক ঘরে নীচে বিছানা করিয়া শুইতেছে। দেয়ালে পরেশবাবুর একখানি ছবি টাঙানো। পাশের একটি ছোটো ঘরে সতীশের খাট পড়িয়াছে এবং এক ধারে একটি ছোটো টেবিলের উপর দোয়াত কলম খাতা বই স্লেট বিশৃঙ্খলভাবে ছড়ানো রহিয়াছে। সতীশ ইস্কুলে গিয়াছে। বাড়ি নিস্তব্ধ।
আহারান্তে হরিমোহিনী তাঁহার মাদুরের উপর শুইয়া নিদ্রার উপক্রম করিতেছেন, এবং সুচরিতা পিঠে মুক্ত চুল মেলিয়া দিয়া শতরঞ্চে বসিয়া কোলের উপর বালিশ লইয়া এক মনে কী পড়িতেছে। সম্মুখে আরো কয়খানা বই পড়িয়া আছে।
ললিতাকে হঠাৎ ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া সুচরিতা যেন লজ্জিত হইয়া প্রথমটা বই বন্ধ করিল, পরক্ষণে লজ্জার দ্বারাই লজ্জাকে দমন করিয়া বই যেমন ছিল তেমনি রাখিল। এই বইগুলি গোরার রচনাবলী।
হরিমোহিনী উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, “এসো, এসো মা, ললিতা এসো। তোমাদের বাড়ি ছেড়ে সুচরিতার মনের মধ্যে কেমন করছে সে আমি জানি। ওর মন খারাপ হলেই ঐ বইগুলো নিয়ে পড়তে বসে। এখনই আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম তোমরা কেউ এলে ভালো হয়— অমনি তুমি এসে পড়েছ— অনেক দিন বাঁচবে মা!”
ললিতার মনে যে কথাটা ছিল সুচরিতার কাছে বসিয়া সে একেবারেই তাহা আরম্ভ করিয়া দিল। সে কহিল, “সুচিদিদি, আমাদের পাড়ায় মেয়েদের জন্যে যদি একটা ইস্কুল করা যায় তা হলে কেমন হয়।”
হরিমোহিনী অবাক হইয়া কহিলেন, “শোনো একবার কথা! তোমরা ইস্কুল করবে কী!”
সুচরিতা কহিল, “কেমন করে করা যাবে বল্। কে আমাদের সাহায্য করবে? বাবাকে বলেছিস কি?”
ললিতা কহিল, “আমরা দুজনে তো পড়াতে পারব। হয়তো বড়দিদিও রাজি হবে।”