গোরা

এইরূপ ছাত্রী-সন্ধানে সে নিজেও লাগিল, সুধীরকেও লাগাইয়া দিল।

সেকালে পরেশবাবুর মেয়েদের পড়াশুনার খ্যাতি বহুদূর বিস্তৃত ছিল। এমন-কি, সে খ্যাতি সত্যকেও অনেক দূরে ছাড়াইয়া গিয়াছিল। এজন্য ইঁহারা মেয়েদের বিনা বেতনে পড়াইবার ভার লইবেন শুনিয়া অনেক পিতামাতাই খুশি হইয়া উঠিলেন।

প্রথমে পাঁচ-ছয়টি মেয়ে লইয়া দুই-চার দিনেই ললিতার ইস্কুল বসিয়া গেল। পরেশবাবুর সঙ্গে এই ইস্কুলের কথা আলোচনা করিয়া ইহার নিয়ম বাঁধিয়া ইহার আয়োজন করিয়া সে নিজেকে এক মুহূর্ত সময় দিল না। এমন-কি, বৎসরের শেষে পরীক্ষা হইয়া গেলে মেয়েদের কিরূপ প্রাইজ দিতে হইবে তাহা লইয়া লাবণ্যর সঙ্গে ললিতার রীতিমত তর্ক বাধিয়া গেল— ললিতা যে বইগুলার কথা বলে লাবণ্যর তাহা পছন্দ হয় না, আবার লাবণ্যর সঙ্গে ললিতার পছন্দরও মিল হয় না। পরীক্ষা কে কে করিবে তাহা লইয়াও একটু তর্ক হইয়া গেল। লাবণ্য মোটের উপরে যদিও হারানবাবুকে দেখিতে পারিত না, কিন্তু তাঁহার পাণ্ডিত্যের খ্যাতিতে সে অভিভূত ছিল। হারানবাবু তাহাদের বিদ্যালয়ের পরীক্ষা অথবা শিক্ষা অথবা কোনো-একটা কাজে নিযুক্ত থাকিলে সেটা যে বিশেষ গৌরবের বিষয় হইবে এ বিষয়ে তাহার সন্দেহমাত্র ছিল না। কিন্তু ললিতা কথাটাকে একেবারেই উড়াইয়া দিল— হারানবাবুর সঙ্গে তাহাদের এ বিদ্যালয়ের কোনোপ্রকার সম্বন্ধই থাকিতে পারে না।

দুই-তিন দিনের মধ্যেই তাহার ছাত্রীর দল কমিতে কমিতে ক্লাস শূন্য হইয়া গেল। ললিতা তাহার নির্জন ক্লাসে বসিয়া পদশব্দ শুনিবামাত্র ছাত্রী-সম্ভাবনায় সচকিত হইয়া উঠে, কিন্তু কেহই আসে না। এমন করিয়া দুই প্রহর যখন কাটিয়া গেল তখন সে বুঝিল একটা কিছু গোল হইয়াছে।

নিকটে যে ছাত্রীটি ছিল ললিতা তাহার বাড়িতে গেল। ছাত্রী কাঁদোকাঁদো হইয়া কহিল, “মা আমাকে যেতে দিচ্ছে না।”

মা কহিলেন, অসুবিধা হয়। অসুবিধাটা যে কী তাহা স্পষ্ট বুঝা গেল না। ললিতা অভিমানিনী মেয়ে; সে অন্য পক্ষে অনিচ্ছার লেশমাত্র লক্ষণ দেখিলে জেদ করিতে বা কারণ জিজ্ঞাসা করিতে পারেই না। সে কহিল, “যদি অসুবিধা হয় তা হলে কাজ কী!”

ললিতা ইহার পরে যে বাড়িতে গেল সেখানে স্পষ্ট কথাই শুনিতে পাইল। তাহারা কহিল, “সুচরিতা আজকাল হিন্দু হইয়াছে, সে জাত মানে, তাহার বাড়িতে ঠাকুরপূজা হয়, ইত্যাদি।”

ললিতা কহিল, “সেজন্য যদি আপত্তি থাকে তবে নাহয় আমাদের বাড়িতেই ইস্কুল বসবে।”

কিন্তু ইহাতেও আপত্তির খণ্ডন হইল না, আরো-একটা কিছু বাকি আছে। ললিতা অন্য বাড়িতে না গিয়া সুধীরকে ডাকাইয়া পাঠাইল। জিজ্ঞাসা করিল, “সুধীর, কী হয়েছে সত্য করে বলো তো।”

সুধীর কহিল, “পানুবাবু তোমাদের এই ইস্কুলের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছেন।”

ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, দিদির বাড়িতে ঠাকুরপুজো হয় ব’লে?”

সুধীর কহিল, “শুধু তাই নয়।”

ললিতা অধীর হইয়া কহিল, “আর কী, বলোই-না।”

সুধীর কহিল, “সে অনেক কথা।”

ললিতা কহিল, “আমারও অপরাধ আছে বুঝি?”

সুধীর চুপ করিয়া রহিল। ললিতা মুখ লাল করিয়া বলিল, “এ আমার সেই স্টীমার-যাত্রার শাস্তি! যদি অবিবেচনার কাজ করেই থাকি তবে ভালো কাজ করে প্রায়শ্চিত্ত করার পথ আমাদের সমাজে একেবারেই বন্ধ বুঝি! আমার পক্ষে সমস্ত শুভকর্ম এ সমাজে নিষিদ্ধ? আমার এবং আমাদের সমাজের আধ্যাত্মিক উন্নতির এই প্রণালী তোমরা ঠিক করেছ!”

সুধীর কথাটাকে একটু নরম করিবার জন্য কহিল, “ঠিক সেজন্যে নয়। বিনয়বাবুরা পাছে ক্রমে এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত