গোরা

বলিয়া খাতাটার প্রতি নিতান্ত ঝুঁকিয়া পড়িলেন।

ললিতা কহিল, “আমি বেশিক্ষণ তোমাকে বিরক্ত করব না। একটা কথা জানতে চাই। বিনয়বাবু এসেছিলেন?”

বরদাসুন্দরী খাতা হইতে মুখ না তুলিয়া কহিলেন, “হাঁ।”

ললিতা। তাঁর সঙ্গে তোমার কী কথা হল?

“সে অনেক কথা।”

ললিতা। আমার সম্বন্ধে কথা হয়েছিল কি না?

বরদাসুন্দরী পলায়নের পন্থা না দেখিয়া কলম ফেলিয়া খাতা হইতে মুখ তুলিয়া কহিলেন, “তা বাছা, হয়েছিল। দেখলুম যে ক্রমেই বাড়াবাড়ি হয়ে পড়ছে— সমাজের লোকে চার দিকেই নিন্দে করছে, তাই সাবধান করে দিতে হল।”

লজ্জায় ললিতার মুখ লাল হইয়া উঠিল, তাহার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করিতে লাগিল। জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা কি বিনয়বাবুকে এখানে আসতে নিষেধ করেছেন?”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তিনি বুঝি এ-সব কথা ভাবেন? যদি ভাবতেন তা হলে গোড়াতেই এ-সমস্ত হতে পারত না।”

ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “পানুবাবু আমাদের এখানে আসতে পারবেন?”

বরদাসুন্দরী আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “শোনো একবার! পানুবাবু আসবেন না কেন?”

ললিতা। বিনয়বাবুই বা আসবেন না কেন?

বরদাসুন্দরী পুনরায় খাতা টানিয়া লইয়া কহিলেন, “ললিতা, তোর সঙ্গে আমি পারি নে বাপু! যা, এখন আমাকে জ্বালাস নে— আমার অনেক কাজ আছে।”

ললিতা দুপুরবেলায় সুচরিতার বাড়িতে ইস্কুল করিতে যায় এই অবকাশে বিনয়কে ডাকাইয়া আনিয়া বরদাসুন্দরী তাঁহার যাহা বক্তব্য বলিয়াছিলেন। মনে করিয়াছিলেন, ললিতা টেরও পাইবে না। হঠাৎ চক্রান্ত এমন করিয়া ধরা পড়িল দেখিয়া তিনি বিপদ বোধ করিলেন। বুঝিলেন, পরিণামে ইহার শান্তি নাই এবং সহজে ইহার নিষ্পত্তি হইবে না। নিজের কাণ্ডজ্ঞানহীন স্বামীর উপর তাঁহার সমস্ত রাগ গিয়া পড়িল। এই অবোধ লোকটিকে লইয়া ঘরকন্না করা স্ত্রীলোকের পক্ষে কী বিড়ম্বনা!

ললিতা হৃদয়-ভরা প্রলয়ঝড় বহন করিয়া লইয়া চলিয়া গেল। নীচের ঘরে বসিয়া পরেশবাবু চিঠি লিখিতেছিলেন, সেখানে গিয়াই একেবারে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, বিনয়বাবু কি আমাদের সঙ্গে মেশবার যোগ্য নন?”

প্রশ্ন শুনিয়াই পরেশবাবু অবস্থাটা বুঝিতে পারিলেন। তাঁহার পরিবার লইয়া সম্প্রতি তাঁহাদের সমাজে যে আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছে তাহা পরেশবাবুর অগোচর ছিল না। ইহা লইয়া তাঁহাকে যথেষ্ট চিন্তা করিতেও হইতেছে। বিনয়ের প্রতি ললিতার মনের ভাব সম্বন্ধে যদি তাঁহার মনে সন্দেহ উপস্থিত না হইত তবে তিনি বাহিরের কথায় কিছুমাত্র কান দিতেন না। কিন্তু যদি বিনয়ের প্রতি ললিতার অনুরাগ জন্মিয়া থাকে তবে সে স্থলে তাঁহার কর্তব্য কী সে প্রশ্ন তিনি বারবার নিজেকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। প্রকাশ্যভাবে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা লওয়ার পর তাঁহার পরিবারে আবার এই একটা সংকটের সময় উপস্থিত হইয়াছে। সেইজন্য এক দিকে একটা ভয়