মালঞ্চ
রমেন উঠে পড়ল

আদিত্য। তোমার বউদি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, আয়া এসে এইমাত্র জানিয়ে গেল।

রমেন চলে গেল, সরলাও তখনি উঠে যাবার উপক্রম করলে

আদিত্য। যেয়ো না সরি, একটু বোসো।. .আমরা দুজনে এ সংসার জীবন আরম্ভ করেছিলেম একেবারে এক হয়ে। এত সহজ আমাদের মিল যে, এর মধ্যে কোনো ভেদ কোনো কারণে ঘটতে পারে সে কথা মনে করাই অসম্ভব। তাই কি নয় সরি?

সরলা। অঙ্কুরে যা এক থাকে, বেড়ে উঠে তা ভাগ হয়ে যায় এ কথা না মেনে তো থাকবার জো নেই আদিৎদা।

আদিত্য। সে ভাগ তো বাইরে, কেবল চোখে দেখার ভাগ। অন্তরে তো প্রাণের মধ্যে ভাগ হয় না। আজ তোমাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নেবার ধাক্কা এসেছে। আমাকে যে এত বেশি বাজবে এ আমি কোনাদিন ভাবতেই পারতুম না। সরি, তুমি কি জান, কী ধাক্কাটা এল হঠাৎ আমাদের ’পরে?

সরলা। জানি ভাই, তুমি জানবার আগে থাকতেই।

আদিত্য। সইতে পারবে সরি?

সরলা। সইতেই হবে।

আদিত্য। মেয়েদের সহ্য করবার শক্তি কি আমাদের চেয়ে বেশি, তাই ভাবি।

সরলা। তোমরা পুরুষমানুষ দুঃখের সঙ্গে লড়াই করো, মেয়েরা যুগে যুগে দুঃখ কেবল সহ্যই করে। চোখের জল আর ধৈর্য এ ছাড়া আর তো কিছু সম্বল নেই তাদের।

আদিত্য। তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে যাবে এ আমি ঘটতে দেব না, দেব না। এ অন্যায়, এ নিষ্ঠুর অন্যায়।


বলে উত্তেজনায় হাতের মুঠি শক্ত করলে। সরলা কোলের উপর আদিত্যের হাতখানা নিয়ে তার উপরে ধীরে
ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বলে গেল যেন আপন মনে ধীরে ধীরে—


সরলা। ন্যায় অন্যায়ের কথা নয় ভাই, সম্বন্ধের বন্ধন যখন ফাঁস হয়ে ওঠে তার ব্যথা বাজে নানা লোকের মধ্যে, টানাটানি পড়ে নানা দিক থেকে, কাকেই বা দোষ দেব?

আদিত্য। তুমি সহ্য করতে পারবে তা জানি। একদিনের কথা মনে পড়ছে। কী চুল ছিল তোমার, এখনো আছে। সেই চুলের গর্ব ছিল তোমার মনে। সবাই সেই গর্বে প্রশ্রয় দিত। একদিন ঝগড়া হল তোমার সঙ্গে। দুপুরবেলা বালিশের ‘পরে চুল মেলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। আমি কাঁচি হাতে অন্তত আধহাত-খানেক কেটে দিলেম। তখনি জেগে তুমি দাঁড়িয়ে উঠলে, তোমার ঐ কলো চোখ আরো কালো হয়ে উঠল। শুধু বললে—‘মনে করেছ আমাকে জব্দ করবে? বলে আমার হাত থেকে কাঁচি টেনে নিয়ে ঘাড় পর্যন্ত চুল কেটে ফেললে কচকচ করে। মেসোমশায় তোমাকে দেখে আশ্চর্য।’ বললেন ‘এ কী কাণ্ড।’ তুমি শান্তমুখে অনায়াসে বললে, ‘বড়ো গরম লাগে।’ তিনিও একটু হেসে সহজেই মেনে নিলেন। প্রশ্ন করলেন না, ভর্ৎসনা করলেন না, কেবল কাঁচি নিয়ে সমান করে দিলেন তোমার চুল। তোমারি তো জ্যাঠামশায়।

সরলা। (হেসে) তোমার যেমন বুদ্ধি, তুমি ভাবছ এটা আমার ক্ষমার পরিচয়? একটুকুও নয়। সেদিন তুমি আমাকে যতটা জব্দ করেছিলে তার চেয়ে অনেক বেশি জব্দ করেছিলুম আমি তোমাকে। ঠিক কি না বলো।