মালঞ্চ
দেখিয়ে দিয়েছেন তিনিই। তাঁরই স্নেহের ধন সরলা সর্বস্বান্ত নিঃসহায়। আজ ওকে যদি ভাসিয়ে দিই তো অধর্ম হবে। তোমার প্রতি ভালোবাসার খাতিরেও পারব না।
অনেক ভেবে স্থির করেছি, আমাদের ব্যবসায়ে নতুন বিভাগ একটা খুলব, ফুল-সবজির বীজ তৈরির বিভাগ। মানিকতলায় বাড়ি সুদ্ধ জমি পাওয়া যেতে পারবে। সেইখানেই সরলাকে বসিয়ে দেব কাজে। এই কাজ আরম্ভ করবার মতো নগদ টাকা হাতে নেই আমার। আমাদের এই বাগানবাড়ি বন্ধক রেখে টাকা তুলতে হবে। এ প্রস্তাবে রাগ কোরো না এ আমার একান্ত অনুরোধ। মনে রেখো, সরলার জ্যাঠামশায় আমার এই বাগানের জন্যে আমাকে মূলধন বিনা সুদে ধার দিয়েছিলেন, শুনেছি তারও কিছু অংশ তাঁকে ধার করতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কাজ সুরু করে দেবার মতো বীজ, কলমের গাছ, দুর্লভ ফুলের চারা, অর্কিড, ঘাসকাটা কল ও অন্যান্য অনেক যন্ত্র দান করেছেন বিনামূল্যে। এত বড়ো সুযোগ যদি আমাকে না দিতেন আজ ত্রিশ টাকা বাড়ি ভাড়ায় কেরানিগিরি করতে হত, তোমার সঙ্গে বিবাহ ঘটত না কপালে। তোমার সঙ্গে কথা হবার পর এই প্রশ্নই বার বার মনে আমার হয়েছে, আমিই ওকে আশ্রয় দিয়েছি, না, আমাকেই আশ্রয় দিয়েছে সরলা। এ সহজ কথাটাই ভুলে ছিলুম, তুমিই আমাকে দিলে মনে করিয়ে। এখন তোমাকেও মনে রাখতে হবে। কখনো ভেবো না সরলা আমার গলগ্রহ। ওদের ঋণ শোধ করতে পারব না কোনোদিন, ওর দাবিরও অন্ত থাকবে না আমার ’পরে। তোমার সঙ্গে কখনো যাতে ওর দেখা না হয় সে চেষ্টা রইল মনে। কিন্তু আমার সঙ্গে ওর সম্বন্ধ যা বিচ্ছিন্ন হবার নয় সে কথা যেমন বুঝেছি এমন এর আগে কখনো বুঝি নি। সব কথা বলতে পারলুম না, আমার দুঃখ আজ কথার অতীত হয়ে গেছে। যদি অনুমানে বুঝতে পার তো পারলে, নইলে জীবনে এই প্রথম আমার বেদনা, যা রইল তোমার কাছে অব্যক্ত।”
চিঠি পড়া শেষ হলে রমেন চুপ করে রইল।

নীরজা। (ব্যাকুলভাবে) কিছু একটা বলো ঠাকুরপো।

রমেন নিরুত্তর : নীরজা তখন বিছানার উপর লুটিয়ে পড়ে বালিশে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বললে—

অন্যায় করেছি, আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু কেউ কি তোমরা বুঝতে পার না কিসে আমার মাথা দিল খারাপ করে?

রমেন। কী করছ বউদি, শান্ত হও, তোমার শরীর যে যাবে ভেঙে।

নীরজা। এই ভাঙা শরীরই তো আমার কপাল ভেঙেছে। ওর জন্যে মমতা কিসের? তাঁর ’পরে আমার অবিশ্বাস এ দেখা দিল কোথা থেকে? এ যে অক্ষম জীবন নিয়ে আমার নিজেরই উপরে অবিশ্বাস। সেই তাঁর নীরু আজ আছে কোথায়, যাকে তিনি কখনো বলতেন ‘বনলক্ষ্মী’। আজ কে নিলে কেড়ে তার উপবন? আমার কি একটা নাম ছিল? কাজ সেরে আসতে যেদিন তাঁর দেরি হত আমি বসে থাকতুম তাঁর খাবার আগলে, তখন আমাকে ডেকেছেন ‘অন্নপূর্ণা’। সন্ধ্যাবেলায় তিনি বসতেন দিঘির ঘাটে, ছোটো রুপোর থালায় বেলফুল রাশ করে তার উপরে পান সাজিয়ে দিতাম তাঁকে, হেসে আমাকে বলতেন, ‘তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী’। সেদিন সংসারের সব পরামর্শই আমার কাছ থেকে নিয়েছেন তিনি। আমাকে নাম দিয়েছিলেন, ‘গৃহসচিব’ কখনো-বা ‘হোম সেক্রেটারি’। আমি যেন সমুদ্রে এসেছিলেম ভরা নদী, ছড়িয়েছিলেম নানা শাখা নানা দিকে। সব শাখাতেই আজ একদণ্ডে জল গেল শুকিয়ে, বেরিয়ে পড়ল পাথর।

রমেন। বউদি, আবার তুমি সেরে উঠবে—তোমার আসন আবার অধিকার করবে পূর্ণ শক্তি দিয়ে।

নীরজা। মিছে আশা দিয়ো না ঠাকুরপো। ডাক্তার কী বলে সে আমার কানে আসে। সেইজন্যেই এতদিনের সুখের সংসারকে এত করে আঁকড়ে ধরছে আমার এই কাঙাল নৈরাশ্য। রমেন। দরকার কী বউদি? আপনাকে এতদিন তো ঢেলে দিয়েছ তোমার সংসারে। তার চেয়ে বড়ো কথা আর কিছু আছে কি? যেমন দিয়েছ তেমনি পেয়েছ, এত পাওয়াই বা কোন্‌ মেয়ে পায়? যদি