প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
কমলমুখী। না ভাই ইন্দু, ও রকম করে তুই বলিস নে। তুই যতটা বাড়িয়ে দেখছিস আসলে ততটা কিছু নয়—
ইন্দুমতী। না, তা কিছু নয়! তিনি অতি উত্তম কাজ করেছেন—বাঙালির ঘরে এতবড়ো মহাপুরুষ আর জন্মগ্রহণ করেন নি—ওঁর মহত্ত্বের কথা সোনার জলে ছাপিয়ে কপালে মেরে ওঁকে একবার ঘরে ঘরে দেখিয়ে আনলে হয়! দিদি, এই কদিনে তোর বুদ্ধি খারাপ হয়ে গেছে। তুই কি বলতে চাস আমাদের বিনোদবাবু ভারি উদার স্বভাবের পরিচয় দিয়েছেন।
কমলমুখী। তুই ভাই, সব কথা বড়ো বেশি বাড়িয়ে বলিস, ওটা তোর একটা দোষ ইন্দু। একবার ভালো করে ভেবে দেখ্ দেখি, হঠাৎ একজন লোককে বলা গেল আজ থেকে তুমি অমুক লোকটাকে ভালোবাসবে, সে যদি অমনি তক্খনি ঘোড়ায় চড়ে আদেশ পালন করতে না পারে তা হলে তাকে কি দোষ দেওয়া যায়। বিয়ের মন্তর সত্যি যদি ভালোবাসার মন্তর হত তা হলে খেমাপিসির এমন দুর্দশা কেন, তা হলে বিরাজদিদি এতকাল কেঁদে মরছেন কেন।
ইন্দুমতী। ভাই, তোকে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। বিয়ের মন্তর যে ভালোবাসার মন্তর নয় তা কে বলবে। আচ্ছা দিদি, এক রাত্তিরে তোর এত ভালোবাসা জন্মাল কোথা থেকে—বিয়ে হলে কী রকম মনে হয় আমাকে সত্যি করে বল্ দেখি।
কমলমুখী। কী জানি, বিয়ের পরেই মনে হয়, বিধাতা সমস্ত জগৎ থেকে একটি মানুষকে স্বতন্ত্র করে নিয়ে তার সমস্ত সুখদুঃখের ভার আমার উপর দিলেন—আমি তাকে দেখব, সেবা করব, যত্ন করব, তার সংসারের ভার লাঘব করব, আর-সকলের কাছ থেকে তার সমস্ত দোষ দুর্বলতা আবরণ করে রেখে দেব। এইমাত্র যে তাকে বিয়ে করলুম তা মনে হয় না; মনে হয় আজন্মকাল এবং জন্মাবার পূর্বে থেকে এই একমাত্র মানুষের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হয়েছিল—
ইন্দু্মতী। তোর যদি এতটা হল, তো বিনোদবাবুর হয় না কেন।
কমলমুখী। তুই বুঝিস নে ইন্দু, ওরা যে পুরুষমানুষ। আমাদের এক ভাব ওদের আর-এক ভাব। জানিস নে, মার কোলে ছেলেটি হবামাত্রই সে কালোই হোক আর সুন্দরই হোক তাকে সেই মুহূর্ত থেকে ভালোবাসতে না পারলে এ সংসার চলে না—তেমনি স্ত্রীর অদৃষ্টে যে-স্বামীই জোটে তক্খনি যদি সে তাকে ভালোবাসতে না পারে তা হলে সে স্ত্রীরই বা কী দশা হয় আর এই পৃথিবীই বা টেঁকে কী করে। মেয়েমানুষের ভালোবাসা সবুর করতে পারে না, বিধাতা তার হাতে সে অবসর দেন নি। পুরুষমানুষ রয়ে বসে অনেক ঠেকে অনেক ঘা খেয়ে তার পরে ভালোবাসতে শেখে, ততদিন পৃথিবী সবুর করে থাকে,কাজের ব্যাঘাত হয় না।
ইন্দুমতী। ইস! কী সব নবাব! আচ্ছা, দিদি, তুই কি বলিস নিমে গয়লার সঙ্গে আজই যদি আমার বিয়ে হয় অমনি কাল ভোর থেকেই তাড়াতাড়ি তার চরণদুটো ধরে সেবা করতে বসে যাব—মনে করব, ইনি আমার চিরকালের গয়লা, আমার পূর্বজন্মের গয়লা, বিধাতা এঁকে এবং এঁর অন্য গোরুগুলিকে গোয়ালসুদ্ধ আমারই হাতে সমর্পণ করে দিয়েছেন।
কমলমুখী। ইন্দু, তুই কী যে বকিস আমি তোর সঙ্গে পেরে উঠি নে। নিমে গয়লাকে তুই বিয়ে করতে যাবি কেন—সে একে গয়লা তাতে আবার তার দুই বিয়ে।