নলিনী
আমি যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! আহা, তাকে আর একবার তেমনি ক’রে দেখতে ইচ্ছে করচে! এই পরিচিত গাছপালাগুলির মধ্যে সূর্য্যালোকে সে তেমনি ক’রে বেড়াক, আমি এই খানে চুপ ক’রে ব’সে ব’সে তাই দেখি। আমি তাকে আর ভালোবাসি নে বটে, কিন্তু তাই বলে তার যতটুকু সুন্দর তা আমার ভালো না লাগবে কেন? আহা, সে পুরানো দিনগুলি কোথায় গেল?

নীরজা। এ বাগানটি কি সুন্দর!

নীরদ। তুমি কেবল এর সৌন্দর্য্য দেখছ – আমি আরো অনেক দেখতে পাচ্ছি। এই বাগানের প্রত্যেক গাছের ছায়ায় প্রত্যেক লতাকুঞ্জে আমার জীবনের এক একটি দিন, এক একটি মুহুর্ত ব’সে রয়েছে! বাগানের চার দিকে তারা সব ঘিরে রয়েচে! তারা কি আমাকে দেখে আজ চিনতে পারছে? অপরিচিত লোকের মত আমাকে তারা কি আজ কৌতূহলদৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে! এমন এক কাল গিয়েচে, যখন প্রতিদিন আমি এই বাগানে আসতুম, গাছপালাগুলি প্রতিদিন আমার জন্যে যেন অপেক্ষা ক’রে থাকত, আমি এলে আমাকে যেন এসো এসো বলে ডাকত। আজ কি তারা আর আমাকে সে রকম ক’রে ডাকচে? তারা হয়ত বলচে,তুমি কে এখেনে এলে? ও কি নীরজা, তোমার মুখখানি অমন মলিন হয়ে এল কেন?

নীরজা। প্রিয়তম, তোমার সেই পুরণো দিনগুলির মধ্যে আমি তো একেবারেই ছিলুম না! এমন এক দিন ছিল যখন তুমি আমাকে একেবারেই জানতে না, একেবারেই আমি তোমার পর ছিলুম – তখন যদি কেউ গল্পচ্ছলে আমার কথা তোমার কাছে বলত তুমি হয়ত একটিবার মন দিয়ে শুনতে না,যদি কেউ বলোত আমি ম’রে গেছি,তোমার চোখে একটি ফোঁটা জল পড়ত না! এককালে- যে আমি তোমার কেউই ছিলুম না এ মনে করলে কেমন প্রাণে ব্যথা বাজে! অনন্তকাল হতে আমাদের মিলন হয় নি কেন?

নীরদ। কেন হয় নি নীরজা? এই মধুর গাছপালাগুলি তোমার স্মৃতির সঙ্গে কেন জড়িয়ে যায় নি? আর এক জনের কথা কেন মনে পড়ে? আহা,যদি সেই জীবনের প্রভাতকালে তোমার ঐ প্রশান্ত মুখখানি দেখতে পেতেম! তোমার এই উদার মমতা,গভীর প্রেম, অতলস্পর্শ হৃদয় –

নীরজা। থাক্‌ থাক্‌ ওসব কথা থাক্‌ – ঐ বুঝি সব গ্রামের লোকেরা আসছে! ঐ শোন বাঁশি বেজে উঠেছে! তবে বুঝি উৎসব আরম্ভ হল! এখন আর আমাদের এ মলিন মুখ শোভা পায় না! এসো আমরাও এ উৎসবে যোগ দিই।

নীরদ। হাঁ চল। একটা গান গাই। আমার বড়ো ইচ্ছে এখনি একবার নলিনী এসে তোমাকে দেখে! তোমার সঙ্গে তার কতখানি প্রভেদ ! সে গাছের ফুল, আর তুমি গাছের ছায়া ! সে দু দন্ডের শোভা, আর তুমি চিরকালের আশ্রয়।

নীরজা। দেখ দেখ, ছায়ার মত শীর্ণ মলিন ও রমণী কে?

নীরদ। ( চমকিয়া ) তাই তো, ও কে?

দূরে নলিনীর প্রবেশ

নীরদ। এ কি নলিনী,না নলিনীর স্বপ্ন?

নীরজা। ( নলিনীর কাছে গিয়া ) তুমি কাদের বাছা গা? আজ এ উৎসবের দিনে তোমার মুখখানি অমন মলিন কেন?

নলিনী। আমি নলিনী।

নীরজা। ( সচকিতে ) তোমার নাম নলিনী?

নলিনী। হাঁ।

নীরজা। ( স্বগত ) আহা, এর মুখখানি কি হয়ে গেছে! নলিনী, আমি তোর মনের দুঃখ বুঝেছি! তাঁকে একবার এর কাছে ডেকে নিয়ে আসি!