দেশনায়ক

বহে বহে নতশির।

কাঁদিয়ে সোহাগ ছিছি একি লাজ,

জগতের মাঝে ভিখারির সাজ,

আপনি করি নে আপনার কাজ -

পরের ‘ পরে অভিমান!

 

ওগো আপনি নামাও কলঙ্কপসরা,

যেয়ো না পরের দ্বার।

পরের পায়ে ধরে মানভিক্ষা করা

সকল ভিক্ষার ছার।

দাও দাও বলে পরের পিছু পিছু

কাঁদিয়া বেড়ালে মেলে না তো কিছু।

যদি মান চাও, যদি প্রাণ চাও,

প্রাণ আগে করো দান।

সেদিন হইতে কুড়ি বৎসরের পরবর্তী ছাত্রগণ আজ নিঃসন্দেহ বলিবেন যে, এখন আমরা আবেদনের থালা নামাইয়া তো হাত খোলসা করিয়াছি, আজ তো আমরা নিজের কাজ নিজে করিবার জন প্রস্তুত হইয়াছি। যদি সত্যই হইয়া থাকি তো ভালোই, কিন্তু পরের ‘পরে অভিমানটুকু কেন রাখিয়াছি—যেখানে অভিমান আছে সেইখানেই যে প্রচ্ছন্নভাবে দাবি রহিয়া গেছে। আমরা পুরুষের মতো বলিষ্ঠভাবে স্বীকার করিয়া না লই কেন যে, আমরা বাধা পাইবই, আমাদিগকে প্রতিকূলতা অতিক্রম করিতে হইবেই; কথায় কথায় আমাদের দুই চক্ষু এমন ছলছল করিয়া আসে কেন। আমরা কেন মনে করি, শত্রুমিত্র সকলে মিলিয়া আমাদের পথ সুগম করিয়া দিবে। উন্নতির পথ যে সুদুস্তর এ কথা জগতের ইতিহাসে সর্বত্র প্রসিদ্ধ-

ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া

দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।

কেবল কি আমরাই—এই দুরত্যয় পথ যদি অপরে সহজ করিয়া সমান করিয়া না দেয় তবে নালিশ করিয়া দিন

কাটাইব, এবং মুখ অন্ধকার করিয়া বলিব, ‘তবে আমরা নিজের তাঁতের কাপড় নিজে পরিব, নিজের বিদ্যালয়ে

নিজে অধ্যয়ন করিব!’ এ-সমস্ত কি অভিমানের কথা!

আমি জিজ্ঞাসা করি, সর্বনাশের সম্মুখে দাঁড়াইয়া কাহারো কি অভিমান মনে আসে, মৃত্যুশয্যার শিয়রে বসিয়া কাহারো কি কলহ করিবার প্রবৃত্তি হইতে পারে। আমরা কি দেখিতেছি না, আমরা মরিতে শুরু করিয়াছি। আমি রূপকের ভাষায় কথা কহিতেছি না—আমরা সত্যই মরিতেছি। যাহাকে বলে বিনাশ, যাহাকে বলে বিলোপ, তাহা নানা বেশ ধারণ করিয়া এই পুরাতন জাতির আবাসস্থলে আসিয়া দেখা দিয়াছে। ম্যালেরিয়ায় শতসহস্র লোক মরিতেছে এবং যাহারা মরিতেছে না তাহারা জীবন্‌মৃত হইয়া পৃথিবীর ভার বৃদ্ধি করিতেছে। এই ম্যালেরিয়া পূর্ব হইতে পশ্চিমে, প্রদেশ হইতে প্রদেশান্তরে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছে। প্লেগ এক রাত্রির অতিথির মতো আসিল; তার পরে বৎসরের পর বৎসর যায়, আজও তাহার নররক্তপিপাসার নিবৃত্তি হইল না। যে বাঘ একবার মনুষ্যমাংসের স্বাদ পাইয়াছে সে যেমন কোনোমতে সে প্রলোভন ছাড়িতে পারে না, দুর্ভিক্ষ তেমনি করিয়া বারংবার ফিরিয়া ফিরিয়া