সাহিত্যের স্বরূপ
‘যা-তা’। কিন্তু আসল কথা, বাস্তবই হচ্ছে মানুষের জ্ঞাত বা অজ্ঞাত-সারে নিজের বাছাই-করা জিনিস। নির্বিশেষে বিজ্ঞানে সমান মূল্য পায় যা-তা। সেই বিশ্বব্যাপী যা-তা বাছাই হয়ে যা আমাদের আপন স্বাক্ষর নিয়ে আমাদের চারপাশে এসে ঘিরে দাঁড়ায় তারাই আমাদের বাস্তব। আর যে-সব অসংখ্য জিনিস নানা মূল্য নিয়ে হাটে যায় ছড়াছড়ি, বাস্তবের মূল্য-বর্জিত হয়ে তারা আমাদের কাছে ছায়া।

পাড়ায় মদের দোকান আছে, সেটাকে ছন্দে বা অছন্দে কাব্যরচনায় ভুক্ত করলেই কোনো কোনো মহলে সস্তা হাততালি পাওয়ার আশা আছে। সেই মহলের বাসিন্দারা বলেন, বহুকাল ইন্দ্রলোকে সুরাপান নিয়েই কবিরা মাতামাতি করেছেন, ছন্দোবদ্ধে শুঁড়ির দোকানের আমেজমাত্র দেন নি—অথচ শুঁড়ির দোকানে হয়তো তাঁদের আনাগোনা যথেষ্ট ছিল। এ নিয়ে অপক্ষপাতে আমি বিচার করতে পারি—কেননা, আমার পক্ষে শুঁড়ির দোকানে মদের আড্ডা যত দূরে ইন্দ্রলোকের সুধাপান-সভা তার চেয়ে কাছে নয়, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ পরিচয়ের হিসাবে। আমার বলবার কথা এই যে, লেখনীর জাদুতে, কল্পনার পরশমণিস্পর্শে, মদের আড্ডাও বাস্তব হয়ে উঠতে পারে, সুধাপানসভাও। কিন্তু সেটা হওয়া চাই। অথচ দিনক্ষণ এমন হয়েছে যে, ভাঙা ছন্দে মদের দোকানে মাতালের আড্ডার অবতারণা করলেই আধুনিকের মার্কা মিলিয়ে যাচনদার বলবে, ‘হাঁ, কবি বটে’, বলবে ‘একেই তো বলে রিয়ালিজ্‌ম্‌’।—আমি বলছি, বলে না। রিয়ালিজ্‌মের দোহাই দিয়ে এরকম সস্তা কবিত্ব অত্যন্ত বেশি চলিত হয়েছে। আর্ট্‌ এত সস্তা নয়। ধোবার বাড়ির ময়লা কাপড়ের ফর্দ নিয়ে কবিতা লেখা নিশ্চয়ই সম্ভব, বাস্তবের ভাষায় এর মধ্যে বস্তা-ভরা আদিরস করুণরস এবং বীভৎসরসের অবতারণা করা চলে। যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দুইবেলা বকাবকি চুলোচুলি, তাদের কাপড়দুটো এক ঘাটে একসঙ্গে আছাড় খেয়ে খেয়ে নির্মল হয়ে উঠছে, অবশেষে সওয়ার হয়ে চলেছে একই গাধার পিঠে, এ বিষয়টা নব্য চতুষ্পদীতে দিব্য মানানসই হতে পারে। কিন্তু বিষয়-বাছাই নিয়ে তার রিয়ালিজ্‌ম্‌ নয়, রিয়ালিজ্‌ম্‌ ফুটবে রচনার জাদুতে। সেটাতেও বাছাইয়ের কাজ যথেষ্ট থাকা চাই, না যদি থাকে তবে অমনতরো অকিঞ্চিৎকর আবর্জনা আর কিছুই হতে পারে না। এ নিয়ে বকাবকি না করে সম্পাদকের প্রতি আমার অনুরোধ এই যে, প্রমাণ করুন, রিয়ালিস্টিক কবিতা কবিতা বটে, কিন্তু রিয়ালিস্টিক বলে নয়, কবিতা বলেই। পূর্বোক্ত বিষয়টা যদি পছন্দ না হয় তো আর-একটা বিষয় মনে করিয়ে দিচ্ছি—বহু দিনের বহুপদাহত ঢেঁকির আত্মকথা। প্রাচীন যুগে অশোক গাছে সুন্দরীর পদস্পর্শ-ব্যাপারের চেয়েও হয়তো একে বেশি মর্যাদা দিতে পারবেন, বিশেষত যদি চরণপাত বেছে বেছে অসুন্দরীদের হয়। আর যদি শুকিয়ে-পড়া খেজুর গাছের উপর কিছু লিখতে চান তা হলে বলতে পারবেন, ওই গাছ আপন রসের বয়সে কত ভিন্ন ভিন্ন জীবনে কত ভিন্ন ভিন্ন রকমের নেশার সঞ্চার করেছে-তার মধ্যে হাসিও ছিল, কান্নাও ছিল, ভীষণতাও ছিল। সেই নেশা যে শ্রেণীর লোকের তার মধ্যে রাজাবাদশা নেই, এমন-কি এম.এ. পরীক্ষার্থী অন্যমনস্ক তরুণ যুবকও নেই যার হাতে কব্জী-ঘড়ি, চোখে চশমা এবং অঙ্গুলিকর্ষণে চুলগুলো পিছনের দিকে তোলা। বলতে বলতে আর-একটা কাব্যবিষয় মনে পড়ল। একটুকুতলানি-ওয়ালা লেবেল-উঠে-যাওয়া চুলের তেলের নিশ্ছিপি একটা শিশি, চলেছে সে তার হারা জগতের অন্বেষণে, সঙ্গে সাথি আছে একটা দাঁতভাঙা চিরুনি আর শেষ ক্ষয় ক্ষয়ে-যাওয়া সাবানের পাৎলা টুকরো। কাব্যটির নাম দেওয়া যেতে পারে ‘আধুনিক রূপকথা’। তার ভাঙা ছন্দে এই দীর্ঘনিশ্বাস জেগে উঠবে যে, কোথাও পাওয়া গেল না সেই খোয়ানো জগৎ। এই সুযোগে সেদিনকার দেউলে অতীতের এই তিনটি উদ্‌বৃত্ত সামগ্রী বিশ্ববিধি ও বিধাতাকে বেশ একটু বিদ্রূপ করে নিতে পারে; বলতে পারে, ‘শৌখিন মরীচিকার ছদ্মবেশ পরে বাবুয়ানার অভিনয় করত ওই মহাকালের নাট্যমঞ্চের সঙ—আজ নেপথ্যে উঁকি মারলে তাকে আর চেনাই যায় না; এমন ফাঁকির জগতে সত্য যদি কাউকে বলা যায় তবে তার প্রতীক বাজার-দরের বাইরেকার আমরা ক’টিই, এই তলানি-তেলের শিশি, এই দাঁতভাঙা চিরুনি আর ক্ষয়ে-যাওয়া পাৎলা সাবানের টুকরো; আমরা রীয়ল, আমরা ঝাঁটানি-মালের ঝুড়ি থেকে আধুনিকতার রসদ জোগাই। আমাদের কথা ফুরোয় যেই, দেখা যায়, নটে গাছটি মুড়িয়েছে।’ কালের গোয়ালঘরের দরজা খোলা, তার গোরুতে দুধ দেয় না, কিন্তু নটে গাছটি মুড়িয়ে যায়। তাই আজ মানুষের সব আশাভরসা-ভালোবাসার মুড়োনো নটে গাছটার এত দাম বেড়ে গেছে