আত্মপরিচয় ১

নামিয়া নামিয়া গেছে বার বার,

হে কবি, তোমার রচিত রাগিণী

আমি কি গাহিতে পারি?

তোমার কাননে সেচিবারে গিয়া

ঘুমায়ে পড়েছি ছায়ায় পড়িয়া,

সন্ধ্যাবেলায় নয়ন ভরিয়া

এনেছি অশ্রুবারি।

যদি এমন হয় যে, আমার বর্তমান জীবনের মধ্যে এই জীবনদেবতার সেবার সম্ভাবনা যতদূর ছিল তাহা নিঃশেষ হইয়া গিয়া থাকে, যে আগুন তিনি জ্বালাইয়া রাখিতে চান আমার বর্তমান জীবনের ইন্ধন যদি ছাই হইয়া গিয়া আর তাহা রক্ষা করিতে না পারে, তবে এ আগুন তিনি কি নিবিতে দিবেন? এ অনাবশ্যক ছাই ফেলিয়া দিতে কতক্ষণ? কিন্তু তাই বলিয়া এই জ্যোতিঃশিখা মরিবে কেন? দেখা তো গিয়াছে, ইহা অবহেলার সামগ্রী নহে। অন্তরে অন্তরে তো বুঝা গিয়াছে, ইহার উপরে অনিমেষ আনন্দের দৃষ্টির অবসান নাই।

এখনি কি শেষ হয়েছে প্রাণেশ,

যা-কিছু আছিল মোর —

যত শোভা যত গান যত প্রাণ,

জাগরণ ঘুমঘোর?

শিথিল হয়েছে বাহুবন্ধন,

মদিরাবিহীন মম চুম্বন,

জীবনকুঞ্জে অভিসারনিশা

আজি কি হয়েছে ভোর?

ভেঙে দাও তবে আজিকার সভা,

আনো নব রূপ, আনো নব শোভা,

নূতন করিয়া লহো আরবার

চিরপুরাতন মোরে।

নূতন বিবাহে বাঁধিবে আমায়

নবীন জীবনডোরে।

নিজের জীবনের মধ্যে এই-যে আবির্ভাবকে অনুভব করা গেছে — যে আবির্ভাব অতীতের মধ্য হইতে অনাগতের মধ্যে প্রাণের পালের উপরে প্রেমের হাওয়া লাগাইয়া আমাকে কাল-মহানদীর নূতন নূতন ঘাটে বহন করিয়া লইয়া চলিয়াছেন, সেই জীবনদেবতার কথা বলিলাম।

এই জীবনযাত্রার অবকাশকালে মাঝে মাঝে শুভমুহূর্তে বিশ্বের দিকে যখন অনিমেষদৃষ্টি মেলিয়া ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিয়াছি তখন আর এক অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করিয়াছে। নিজের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির এক অবিচ্ছিন্ন যোগ, এক চিরপুরাতন একাত্মকতা আমাকে একান্তভাবে আকর্ষণ করিয়াছে। কতদিন নৌকায় বসিয়া সূর্যকরোদীপ্ত জলে স্থলে আকাশে আমার অন্তরাত্মাকে